পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি শুরু হয়েছে। গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এ উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৪টি ক্ষুদ্র নৃ–তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব বৈসাবি উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী চলবে বর্ণাঢ্য আয়োজন। পাহাড়ের প্রতিটি এলাকা এখন উৎসব মুখর। সকল সমপ্রদায়ের উপস্থিতিতে এ উৎসব সমপ্রীতির মিলনমেলায় পরিণত হয়।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, গতকাল বুধবার সকালে চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিজুর মূল আনুষ্ঠানিকতা। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই খাগড়াছড়ির চেঙ্গী ও মাইনী নদীতে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। চাকমা তরুণ তরুণীরা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে বন থেকে সংগ্রহ করা বিজু, মাধবীলতা ও রজ্ঞনসহ নানা রকমের ফুল দিয়ে পুজা করে। পরে নদীর পাড়ে গঙ্গা দেবীর উদ্দ্যেশে প্রার্থনা করা হয়।
ফুল বিজুতে অংশ নেয়া নুপুর চাকমা বলেন, গত বছরের দুঃখ কষ্ট গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে বরণ করে নিব। পাহাড়ে এই উৎসব দেখতে যোগ দেয় পর্যটকরাও।
সকালে ফুল বিজুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, এ ধরনের উৎসবের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শান্তির দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। শান্তি ও সম্প্রীতি আরো উন্নত হবে, আরো মজবুত হবে। উৎসবে অংশ নিয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. নাঈমুল হক জানান, অনুষ্ঠান ঘিরে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। পুলিশের নিয়মিত টহলের পাশাপাশি সাদা পোশাকের পুলিশ নিরাপত্তায় কাজ করছে।
রাঙামাটি : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে কাপ্তাই হ্রদে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে রাঙামাটিতে শুরু হয়েছে চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই ও ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসব। ভোরে রাজবন বিহার ঘাটে আদিবাসী ফোরামের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা নদীতে ফুল নিবেদন করেন। শহরের ত্রিপুরা পল্লীখ্যাত গর্জনতলীতে রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী হ্রদে ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন। এদিকে, সকালে শহরের গর্জনতলি এলাকায় ত্রিপুরাদের হারি বৈসুক উপলক্ষে আয়োজিত বয়স্ক স্নান, বস্ত্রদান, গড়াইয়া নৃত্যসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়।
রাঙামাটি সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ১৪টি জনগোষ্ঠী রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। আজকে হচ্ছে ফুল বিঝু। কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসানোর মাধ্যমে বৈসাবি উৎসব শুরু হয়েছে। উৎসব যাতে ভালোভাবে পালন করতে পারে এ জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্ধ প্রদান করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ যাতে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা করে বিকশিত হতে পারে সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, বলেন, মা গঙ্গার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে হ্রদে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করেছি। সবাই যাতে মিলেমিশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাথে একসাথে বসবাস করতে পারি। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশবাসীকে বিজুর শুভেচ্ছা জানান।
বান্দরবান : বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, শঙ্কামুক্ত মঙ্গলময় পৃথিবী কামনায় বান্দরবানে সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসালেন চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর তরুণ–তরুণীরা। শিশু কিশোর এবং যুবক যুবতীরাও ভিড় জমিয়েছিল নদীপাড়ে বিজু ও বিষু আনন্দ আয়োজনে।
আয়োজকরা জানান, এবার তিন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে।
চাকমা তরুণী সুচরিতা চাকমা ও শুভশ্রী চাকমা বলেন, এটি আমাদের ঐতিহ্যগত উৎসব, যুগযুগ ধরেই পালন করে আসছি। এছাড়াও পাহাড়ি পল্লীগুলোতে বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী পাচনসহ মজাদার সব খাবার, বিহারগুলোতে চলে ধর্মীয় প্রার্থণা, বয়স্কদের প্রণাম করে আর্শীবাদ গ্রহণ। দল বেধে বন্ধু বান্ধব স্বজনরা ঘুরে বেড়াই।
বিষু উৎসব আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ক্রিত্তিমান চাকমা বলেন, বর্ষবরণ ও বর্ষ বিদায়ের এই উৎসবে তিন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। নদীতে ফুল ভাসানো ছাড়াও চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলা নাটিং এবং বাঁশহরম প্রতিযোগিতা রয়েছে। সাংস্কৃতিক আয়োজনে মাতানো হয় চাকমা পল্লীগুলো।
কাপ্তাই : কাপ্তাই প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় তনচংগ্যা সমপ্রদায় গতকাল ভোরে কর্ণফুলী নদীতে ফুল ভাসিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঐতিহ্যবাহী বিষু উৎসব শুরু করেন। পরে কাপ্তাই সড়কে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রশি টানাটানি, লাটিম খেলাসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যময় বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করা হয়।
এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরীসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ। দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পার্বত্য এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক পাহাড়ি বাঙ্গালী নারী পুরুষ হেডম্যান পাড়া কিয়াং মাঠে উপস্থিত ছিলেন।