ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একজন বাঙ্গালির শৈশবকাল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন পালা-পার্বণ ঘিরে বিকশিত হয়। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ একই গ্রামের নানা পাড়ায় জীবন-যাপন করে ঈদ, পূজো ও অন্যান্য উৎসবে সাড়া দেন, মেতে ওঠেন। কবি জীবনানন্দের কবিতায় তার-ই উচ্চকিত পংক্তি- ‘ সন্ন্যাসী আর পীর / মিলে গেছে হেথা,- মিশে গেছে হেথা মসজিদ, মন্দির’ !
সমাজ হিতৈষণার আর্তি মাঝে-মধ্যে প্রাত্যাহিক জীবনের সবকিছু ছাপিয়ে বুকে জায়গা পেতে চায়। এইভাবে বছর-মাস ধরে শিরোনামাঙ্কিত ভাবনাটা মনে মর্মরিত হচ্ছিলো। সমাজতাত্ত্বিক নই, বিষয়টা নিয়ে নেই গভীরতর কোনো পড়াশোনা-তবুও দেশ-জাতির মঙলোন্মুখ জনচিত্তে প্রকাশের অঙিনায় লিখে ছড়িয়ে দেবার তাড়না বলে কথা। ধর্মীয় যাগ-যজ্ঞ ছাড়াও, ছোটবেলাকার অসুখ নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক, দোয়া-দরুদ-গাছা চিকিৎসার আশ্রয় নেওয়ার সুবাদে ঠাকুরদি, মাতামহ-মাতামহী, ও অন্যদের সাথে জন্মগ্রাম ও আশপাশ গ্রামের বিভিন্ন মন্দির, মাজার, দরগাহ্ শরীফের প্রার্থনা অঙ্গনে যাতায়াত করা হয়েছে। যার প্রভাবে বিভিন্ন উপাসনালয়ের প্রার্থনা পদ্ধতির বহু ছাপ শৈশব-কৈশোরক স্মৃতিতে এখনো অম্লান গেঁথে আছে।
তাতে করে লক্ষ্য করা, এই যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-সমূহ, এসবের অনেক স্থানে ধর্মীয় ভাবপোলদ্ধি ছাড়াও আশ্রিত শীর্ণ ক্লিষ্ট বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ঠাঁই হয়। বিশেষভাবে মুগ্ধ করে-‘শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কষ্ট-ক্লিষ্ট প্রাণ’ বাঁচিয়ে রাখার, আর কিছু না হোক অন্ততঃ থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত, দৈহিক ত্রুটি-মানসিক বৈকল্যগ্রস্থ অসহায়দের প্রতি সামাজিক হাত বাড়ানোর এই কর্তব্য-কর্ম। পরবর্তীতে, আরও ভারি, আরও বড় পরিসরে এইধরনের নজরকাড়া কর্মকান্ড চট্টগ্রাম শহরের বিখ্যাত নানা ধর্মালয়ে অবলোকন করা হয়েছে। এতে উপলব্ধি হলো, ধর্মীয় উপাসনালয়ের নেতৃত্বে যদি সৎ ও জনদরদী মানুষজন থাকেন, তবে সমাজের জন্য হিতকর বেশ কিছু কাজ করা সম্ভব।
পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ জাতি-সম্প্রদায়ে বিভিন্ন রকমের ‘ধর্ম বা রিলিজিয়ন’ প্রচলিত রয়েছে। ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন’ বলতে কোনো গোষ্ঠীগত ধর্মীয় পন্থা বা সম্প্রদায় বোঝায়। রসায়ন বিজ্ঞানে ‘ধর্ম’ শব্দটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। যা পদার্থের অবিচ্ছেদ্য মূলগত বৈশিষ্ট্য বোঝায়, যা থেকে ঐসব পদার্থকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না-করলে পদার্থ হারাবে তার নিজস্ব রূপ, স্বরূপ। যেমন, আগুনের ধর্ম তাপ ও আলোক বিকিরণ, জলের ধর্ম স্বচ্ছতা তরলতা, চিনি মিষ্টি, লবণ নোনতা ইত্যাদি। ঐসব বস্তুকে তাদের সহজাত প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানে এই অর্থেই ‘ধমর্’ শব্দটির প্রয়োগ। যাকে আত্মা-বৃত্তি বা ধর্ম বলা হয়। মানবাত্মার ধর্মের নিরিখে সেসব হল- ১. সেবা পরায়ণতা, ২. ভালোবাসা, ও ৩. আনন্দ-তৃষা। যেকারণে প্রত্যেকেই কারও না কারও সেবা করে থাকে-যেমন, পিতামাতা সন্তানের, বন্ধু বন্ধুর, রাষ্ট্রপতি জনগণের। যেকারণে চেতন জীব, অন্যদেরকে ভালবাসবেই-এমনকী কোন কোন মানবাত্মার ভালবাসা বিশ্বমানবতার পতাকা ওড়ানো দ্যুতি নিয়ে আসে। এবং যেকারণে জড় যেখানে নিস্পৃহ নিথর- মানবাত্মা সেখানে থাকতে চায় কাব্য-সাহিত্য-মেলা-উৎসবে অণুক্ষণ আনন্দময়।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব-আশরাফুল মাখলুকাত। মানব সভ্যতায়, সুপ্রাচীনকাল থেকে সামাজিক সংস্কারের সাথে সাথে আত্মার স্বভাব-ধর্ম জাত এই সেবা-পরায়ণতার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক মাঙলিক কর্মসাধনের ব্রত ইতিহাসে মেলে। মানুষের সেবা করা, দুখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো একটি ‘ উত্তম ইবাদত ’ বলে স্বীকৃত। এই ভূখন্ডে মানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন পীর-আউলিয়ারা। খৃষ্টান মিশনারি হাসপাতালগুলো প্রদত্ত চিকিৎসা-সেবা প্রদান কার্যাবলীও এর অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা যায়। ‘বহুজন সুখায় চ, বহুজন হিতায় চ ’- বহুজনের সুখ ও কল্যাণ চিন্তা থেকে বুদ্ধের গৃহত্যাগ সেবা-ধর্মেরই বিস্তৃত রুপ। এই প্রসংগে স্বামী বিবেকানন্দের বহুল উদ্ধৃত-‘জীবপ্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ বাণী স্মরণযোগ্য। তাঁরই প্রর্বতিত রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বহু জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সুতরাং দেখা যায়, পৃথিবীর সকল ধর্মে মানব সেবা-সম্প্রীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছে, সর্ব্বোচ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
জানামতে, চট্টগ্রাম শহরে ও গ্রামে অনেক উপাসনালয় আছে-ভক্তবৃন্দের কাছ থেকে যা স্বস্তফুর্ত অনেক অনুদান, চাঁদা পেয়ে থাকে। এসব আর্থিক যোগান যদি বুদ্ধিদীপ্ততার সাথে সফলভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে নিশ্চিত তা দারিদ্রপীড়িত মানুষের অনেক উপকার সাধন করবে। একথাও ঠিক বহু উপাসনালয় আছে, যেখানে আয় খুবই সংকুচিত, প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের ব্যয়ভার পর্যন্ত বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার উল্টোচিত্রে, দেশের নানা স্থানে প্রথিতযশা নানা উপাসনালয় আছে, যেখানে অগণিত ভক্তকূলের উপস্থিতিতে আর্থিক ভিত্ বেশ মজবুত।
ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের কথা সর্বজনবিদিত। ধর্মীয় উপাসনালয়সমূহের এইরুপ আর্থিক সঞ্চয় তিন ভাগে বিভক্ত করে সুকৌশল প্রায়োগিক নীতিতে কাজে লাগানো যেতে পারে। একভাগ সেই উপাসনাগৃহের অবকাঠামো সুবিধাসহ সকল প্রকারের উন্নয়ন, দ্বিতীয় একভাগ প্রার্থনালয় ঘিরে যে সেবায়েতমণ্ডলীর পরিবার ও পোষ্য রয়েছেন তাদের জন্য ব্যয়, এবং তৃতীয় অংশ স্থানীয়ভাবে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক সেবা প্রদানের পরিষেবায় কাজে লাগানো।
প্রতিষ্টানসমূহের অর্থনৈতিক শক্তি স্বচ্ছতার সাথে তেভাগা নীতির মতো কর্মকৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজ, জাতি ও দেশের জন্য হিতকর হতে পারে। সংশ্লিষ্ট এলাকার উপাসনালয় দারিদ্রপীড়িত স্ব-স্ব জনতার কোনোটা শিক্ষা, কোনোটা চিকিৎসার ভার গ্রহণ করতে পারে। মাতৃ-শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা, মুমূর্ষ রোগীর এমবুলেন্স সার্ভিস, কিংবা শিশু-কিশোরদের জন্য পাঠাগার, খেলাধুলা-ব্যায়ামচর্চা জাতীয় সু-বিনোদনের মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া যায়। চাইলে আহার অনুষ্টান-বিলাস ব্যয় সীমিত রেখে পুঁজির ভান্ডার স্ফীত করে এইসবদিকে আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে পারে প্রতিষ্টানের আধিকারিকরা। আর এইরকম কোনো মাঙলিক কর্মের সূচনা দেখলে সমাজের দানশীল ব্যক্তিবর্গ আনন্দিত প্রাণে তাতে হয়তো সাড়া দেবেন সহসা। প্রয়োজন কেবল উদ্যম-উদ্দেশ্যহীন স্বজন পোষণ স্বার্থমগ্ন পরিচালনার পরিবর্তে প্রণামী ও দানবাঙের সৃষ্টিশীল ব্যবস্থাপনা।
‘মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে’-কী মহত্তম উক্তি আমাদের জাতির পিতার! বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তৃণমূল পর্যায়ে দেশের সকল মানুষের ‘সুস্থ জীবন-উন্নত জীবন’ গড়ে দেবার দৃঢ় অঙ্গীকারে নিবিষ্ট। সেইসাথে সহযোগী সংস্থা হিসেবে উপাসনালয়ে গৃহীত ‘তেভাগা মডেল’ অনুসৃত নানা সামাজিক প্রকল্প-আন্দোলনের সোনালি ফসল সমাজজীবন পরিপুষ্ট করবে বলে বিশ্বাস-‘জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’ বাংলাদেশে।
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।