উপাচার্য না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র জনতার আন্দোলনের পর একে একে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ও রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এনিম্যাল এন্ড সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) উপাচার্যসহ প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ পদত্যাগ করেন। এর মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান চবির রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রফেসর মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রশাসন নিয়োগ দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। যার কারণে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। এতে সেশনজটের শঙ্কায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাজারো শিক্ষার্থী। গত এক সপ্তাহ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন করছেন সিভাসু শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে পুরো অচল হয়ে পড়েছে সিভাসু ক্যাম্পাস। সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
জানা যায়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর সিভাসু উপাচার্য এ এস এম লুৎফুল আহসান পদত্যাগ করেন। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর উপাচার্য নিয়োগের আবেদন জানিয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেন সিভাসুর শিক্ষার্থীরা। এতে কেমন উপাচার্য চান, তা তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত ব্যক্তির উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং গবেষণাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান থাকা জরুরি। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষায় দক্ষতা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকাও অপরিহার্য। এছাড়া স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, শিক্ষার্থীবান্ধব কোনো শিক্ষককে এই পদে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানানো হয়। এক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সহিংসতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া কাউকে বা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিকে উপাচার্য হিসেবে মেনে নেবেন না বলে জানান শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভাসুতে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে– এমন আভাস পেয়ে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ৩ অক্টোবর ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। ৪ অক্টোবর রাতে মশাল মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। গত ৫ অক্টোবর ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে জাকির হোসেন সড়ক বন্ধ করে ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হয়। গত রোববার শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে কমপ্লিট শাটডাউন বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। সর্বশেষ গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্য থেকে উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। এতে অংশ নেন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বড় অংশ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টির শ্রেণি ও প্রশাসনিক সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এছাড়া ১৪ আগস্ট শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে চুয়েট তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর মোহাম্মদ রফিকুল আলম পদত্যাগ করেন। এখনো চুয়েটে উপাচার্য পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে চুয়েটে শ্রেণি কার্যকম শুরু হলেও প্রশাসনিক অনেক কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান শিক্ষকরা। এর মধ্যে ২৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িকভাবে প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল অনুষদের ডিন সুদীপ কুমার পাল। জানা যায়, উপাচার্য না থাকায় একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট সভা ও শৃঙ্খলা কমিটির সভা হচ্ছে না। এতে নিয়োগ প্রক্রিয়া, পদোন্নতি, প্রশাসনিক রদবদল আটকে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও বিভিন্ন খাতের কেনাকাটা করা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে ১৭ আগস্ট রাবিপ্রবির উপাচার্য প্রফেসর সেলিনা আখতার ও উপ–উপাচার্য কাঞ্চন চাকমা পদত্যাগ করেন। এখনো এই দুই পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যার ফলে স্থবির হয়ে আছে শিক্ষা কার্যক্রম। সেশনজটের শঙ্কায় রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন পদত্যাগের পর ক্যাম্পাসে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রশাসনিক সংকটের কারণে শিক্ষাক্রম দীর্ঘদিন স্থবির হয়ে আছে। তাছাড়া সেশনজটের তীব্র আশঙ্কা তো আছেই। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন না থাকায় নানারকম সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ দখল করছেন বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। চুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, উপাচার্য না থাকায় প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। শিক্ষার্থীরা অনেক দাবি দাওয়া জানিয়েছে, কিন্তু উপাচার্য না থাকায় এসব দাবি পূরণ করা হচ্ছে না।
সিভাসুর ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের স্নাতকের শিক্ষার্থী মো. শাহরিয়ার হোসেন তালুকদার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রাযাত্রার ক্ষেত্রে উপাচার্যের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল অভ্যন্তরীণ একজন শিক্ষকের পক্ষেই জানা সম্ভব। এজন্য আমরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন করছি। উপাচার্য না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সিভাসুর প্রক্টর প্রফেসর ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। এর আগে জুলাই থেকে নানা কারণে শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাহত হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে আমরা শিক্ষকরাও একমত। কারণ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য দিলে সার্বিকভাবে সিভাসু উপকৃত হবে।
দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ না হলে আরও সংকট তৈরি হবে বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের উপ–উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন। তিনি আজাদীকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। এখানে উপাচার্য না থাকলে জটিলতা তৈরি হয়। কারণ উপাচার্য এখানে সব সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। এজন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ প্রয়োজন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষকদের এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা বিবেচনায় রাখতে পারেন।