উপবৃত্তি-পছন্দমতো এমএফএস অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ

মহিউদ্দিন বাবর | বুধবার , ১ জুন, ২০২২ at ৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ

নভেল করোনাভাইরাস কোভিড ১৯ এর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে গত দুই বছরে যে জীবন প্রায় স্থবির ছিল, এখন তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। মানুষ আবার ফিরে এসেছে জীবনযাপনের স্বাভাবিক চক্রে। ভাইরাসের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে সেখানে মানুষের অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তার ফুটে উঠেছিল। যাই হোক, তথ্য প্রযুক্তি, বিশেষ করে মোবাইল ফোন প্রযুক্তি, সেই অচলাবস্থা ভাঙতে এবং জীবনকে সচল রাখতে যা যা দরকার ছিল তা করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এমনকি নিখুঁতভাবে লকডাউন পরিস্থিতিতেও যাদের জীবন শুধু ঘর এবং চুলায় সীমাবদ্ধ তাদের জন্য আর্থিক লেনদেনটাকে জীবিত রেখেছিল এবং এটি অবশ্যই বেঁচে থাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সরকার আর্থিক উদ্দীপনা ঘোষণা করেছে, শিল্প মালিকেরা শ্রমিকদের বেতন দিয়েছেন, ছাত্ররা একাডেমিক ফি দিয়েছে এবং ভোক্তারা মুদি এবং ইউটিলিটি পরিষেবা বিলগুলি নিষ্পত্তি করতে পেরেছেন ঘরে বসেই। মোবাইল আর্থিক পরিষেবাগুলো না থাকলে পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আরো ভয়াবহ হতো। আনন্দের বিষয় সকল বিপর্যয় কাটিয়ে আমরা এখন নতুন নরমাল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি।

বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টায় গৌরবজনক মাইলফলক অর্জন করেছে, আর এ অর্জনের একটি অনন্য অধ্যায় হল শিক্ষা খাতের উদ্যোগে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের কাছে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা। শিক্ষা খাতের বিভিন্ন উপবৃত্তি কর্মসূচিগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে বাংলাদেশ সরকার সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির (এইচএসপি) প্রবর্তন করেছে। করোনা মহামারীর সময়ে এমএফএসের সহায়তায় উপবৃত্তি বিতরণের মাধ্যমে দেশের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পাথেয় এবং অনুপ্রেরণা পেয়েছে। সরকার সম্প্রতি সুবিধাভোগীদের তার নিজের পছন্দের একটি এমএফএস অ্যাকাউন্ট বেছে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে যা এই পরিষেবার আওতা বাড়াবে বহুগুণ।

উল্লেখ্য, দেশে প্রতি বছর আনুমানিক এক কোটি চল্লিশ লাখ প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রী উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় অর্থ গ্রহণ করছে। একটা সময় ছিল যখন হাতে হাতে উপবৃত্তির অর্থ পৌঁছে দেওয়ার দুরূহ দায়িত্ব পালনে, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। সময়মতন এবং সঠিক ছাত্রছাত্রীর কাছে বৃত্তির অর্থ পৌঁছানোর জটিলতা ছাত্রছাত্রী এবং বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বেড়েই চলতে থাকে। ব্যাংকিং পদ্ধতিতে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করলে সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের বড় একটি অংশ, উপবৃত্তি যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারা এই কর্মসূচীর বাইরে থেকে যেত। এমএফএসের মাধ্যমে বিতরণকৃত উপবৃত্তির অর্থ এখন খুব অল্প সময়ে দেশের সব জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে, এতে উপবৃত্তি বিতরণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা যেমন বেড়েছে তেমনি ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি হ্রাস পেয়েছে।

এমএফএসের মাধ্যমে জিটুপি (গভর্মেন্ট টু পার্সন) পদ্ধতিতে উপবৃত্তির অর্থ সরাসরি সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ এখনো বেশ নতুন, সে কারণে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের স্বার্থেই সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা, ২০২১ এর প্রবর্তন করেছে। জিটুপি পদ্ধতিতে যে কোনো এমএফএসের মাধ্যমে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণের সূচনার আগে উপবৃত্তির অর্থ লোপাট, বিতরণে দুর্নীতি, ভুল সুবিধাভোগীকে অর্থ প্রদান, ছাত্রছাত্রীরা পাস করে বেরিয়ে যাবার পর অর্থ বিতরণ ইত্যাদি নানান অভিযোগে সরকারের এই মহতী উদ্যোগ বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পর্যাপ্ত এজেন্ট পয়েন্ট না থাকা, বা এজেন্টরাই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা রেখে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ এখনো কিছু জায়গায় শোনা যায়। এই বিপত্তি এড়ানোর লক্ষ্যেই সরকারের প্রদেয় নির্দেশিকাতে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ পদ্ধতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ছাত্রছাত্রীদের মা, বাবা বা বৈধ অভিভাবকদের কাছে এই অর্থ বিতরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে বাবা, মা বা অভিভাবকের পছন্দের যে কোনো সচল এমএফএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে, যে একাউন্টের বৈধতা জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে যাচাই করা যাবে। এমএফএস খাতে দীর্ঘ এক দশক যাবত বিভিন্ন সৃজনশীল সেবার সংযোজনে গ্রাহক নিজের প্রয়োজন এবং এজেন্ট নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি অনুযায়ী এমএফএস সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে থাকেন। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় এবং নিরাপদ সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণ সরকারের নির্দেশিকা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।

বিশেষত অনুন্নত, গ্রামীণ এলাকাগুলোতে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে সরকারের উপবৃত্তির অর্থ সহজলভ্য করার এই উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিঃসন্দেহে অপরিহার্য, আর এর পরিপ্রেক্ষিতে বছরে চারবার ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকের এমএফএস একাউন্টে উপবৃত্তির টাকা পাঠানো এক প্রশংসনীয় সাফল্য। এই প্রক্রিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের নির্দেশিকার সঠিক প্রতিপালন এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্ভরযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বিবেচনা করা আবশ্যক।

লেখক : ফ্রিল্যান্স লেখক ও সিএসআর কনসালট্যান্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির মনোজগত গঠন
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে