উন্নয়নের জন্য চাই জনবান্ধব প্রশাসন ও দক্ষ জনশক্তি

নেছার আহমদ | সোমবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৯:১২ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে জনবান্ধব ও গণমুখী সরকারের দেশব্যাপী নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও প্রশাসনের দক্ষতা ও জনবল আশানুরূপভাবে বাড়েনি। ফলে সরকারের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির লক্ষমাত্রা অর্জনের সঙ্গে তাল মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রায় সর্বস্তরের প্রশাসন যন্ত্রকে। বিগত তিন দশক বিশেষ করে বর্তমান সময়ের এক দশকে সরকারের কর্মপরিধি বেড়েছে কয়েকগুণ। অথচ প্রশাসনে জনবল বেড়েছে মাত্র দশমিক ২৭ ভাগ। ফলে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকা পর্যন্ত সুবিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে জনসেবা প্রদানে পদে পদে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের।
পেট্রোবাংলার অধিনস্থ কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিঃ এর সাথে জড়িত থাকতে দেখেছি, সেখানেও একই অবস্থা বিরাজমান। প্রয়োজনের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ জনশক্তি দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। ফলে কোম্পানীটি কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছেন না। বিভিন্ন পর্যায়ে অবসরে চলে গেছে অনেকে। কিন্তু সে অনুযায়ী নিয়োগ হয়নি। এরপরও রয়েছে দক্ষ জনবলের প্রকট অভাব। সীমিত সংখ্যক অদক্ষ জনবল দিয়ে যথার্থ অর্থে একটি উন্নত সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা অসম্ভব।
অপ্রিয় হলেও সত্য, দেশে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের সার্বিক মান ও দক্ষতা ভাল নয়। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম প্রায় সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়। ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীতি নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে এসব অনিয়ম অনাচার দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা অনতিবিলম্বে দূর করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে এবং যারা অবসরে চলে যাচ্ছেন তাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন জনশক্তি তৈরি করার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশে বিপুল জনশক্তি বেকার অথচ দেশীয় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন, জাপান সহ বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করা হচ্ছে কারণ একটাই বাজারের চাহিদানুযায়ী দক্ষ জনশক্তির অভাব। আর একারণেই দেশের বিপুল জনশক্তি তেমন কোন কাজে আসছেনা। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হারে দেশকে বড় ধরনের ঝুঁকির দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি ও সম্পদের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক অনেক বেশি।
বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের মতে, ‘দক্ষিণ এশিয়ার চীন, ভারত, বাংলাদেশ এ তিনটি দেশই ব্যাপক জনবহুল, আর অতিমাত্রায় জনঘনত্ব বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।’
জনসংখ্যার ঘনত্বে এবং বেকারত্বের কারণে গ্রামে ও শহরের মানুষের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে এবং টাকাওয়ালাদের প্রতি ঘৃণা, ক্ষোভ ও হিংসা, ক্রোধ তৈরি হচ্ছে। ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে সমাজের প্রভাবশালী, অর্থশালী আর রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি। ফলে যে কোন সময় শ্রেণী বৈষম্য, শ্রেণী-সংঘর্ষে রুপ নিতে পারে। সুতরাং এসব বিষয় জরুরিভাবে সরকারকে ভাবতে হবে। একবার শ্রেণী সংঘর্ষের আগুন জ্বলে উঠলে দলমত নির্বিশেষে সবার ঘরই পুড়ে ছাড়কার হয়ে যাবে। দেশের উন্নয়ন রুদ্ধ হবে।
আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ‘সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা এবং সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করার চেষ্টা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্তব্য।’ বাংলাদেশকে কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সেবার মানসিকতা সম্পন্ন জনসেবাধর্মী জনপ্রসাশন গড়ে তোলার লক্ষ্যেই বাংলাদেশের সংবিধানে এ মূলমন্ত্র সংযোজন করা হয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য এক সংবিধান হলো বাংলাদেশের সংবিধান। এ সংবিধানের এ মূলমন্ত্র অনুসরণ করা হলে প্রশাসনকে জনবান্ধব না হয়ে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার কোন সুযোগ থাকেনা। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সংবিধানের উক্ত মূলতন্ত্রের পরিপন্থী অনেক সময়ই প্রশাসনকে কর্তৃত্ববাদী হতে দেখা যায়।
কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দক্ষ, যোগ্য এবং আর্থিক ও বুদ্ধিভিত্তিক দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ না দিয়ে একান্ত অনুগত, অন্ধ এবং অপেক্ষাকৃত অদক্ষ, অযোগ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়। এ ধরনের মনমানসিকতার কর্মচারী ও কর্মকর্তারা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারেনা। ফলে উন্নয়নমূলক জনবান্ধব কার্যক্রমের ধারা রুদ্ধ হয়।
প্রকৃত অর্থে জনবান্ধব প্রশাসন সর্বদাই শক্তিশালী প্রশাসন। যারা ব্যর্থতার দায় ও ভুল স্বীকার করে তা সংশোধনের চেষ্টা করে। অপরদিকে কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন চিন্তা ও জ্ঞানের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রশাসন। তারা তাদের চিন্তা, জ্ঞান, দক্ষতা ও সততায় ঘাটতি আড়াল করার জন্য কর্তৃত্ববাদী রূপ ধারণ করে থাকে। তারা জনকল্যাণ মূলক কাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। এ প্রশাসন কখনও সুপরামর্শ গ্রহণ করেনা। তারা নিজেদের মতামতকেই সর্ব্বোচ্চ সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করে। তারা অন্যের ভালো কাজের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল নয়। জনগণের সেবার মনোভাব তাদের থাকেনা। তারা জনগণের সেবক না হয়ে জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
এছাড়া কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন কোনো যুক্তি শুনতে চায় না, কোন যুক্তি মানতে চায়না। গঠনমূলক সমালোচনাও তারা সহ্য করতে পারেনা, কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনে টিম ওয়ার্কের কোন সুযোগ থাকে না। ব্যক্তির ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় প্রশাসন পরিচালিত হয়। তারা কেবল নিজেদের সিদ্ধান্ত অধীনস্থদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
ইদানীং বিভিন্ন অফিস, আদালতে ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়। সরকার প্রধানের পরিকল্পনা এবং উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা তা বাস্তবায়নের পথে না গিয়ে সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উন্ন্‌য়নের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা বিনিয়োগকারী সহ জনগণের উন্নয়ন চিন্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকার এবং জনগণের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। যেমন সরকার দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটানোর জন্য দেশীয় এবং বিদেশী উদ্যোক্তাদেরকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। শিল্পের জন্য সকল প্রকার অবকাঠামোগত সুবিধাদি নিশ্চিতের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন গ্যাস সংযোগ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুতের সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থায় ক্যাপটিভ পাওয়ার সহ সকল সুবিধাদি প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। আজকে এ আইন কালকে নতুন আরেকটি সার্কুলার প্রভৃতির মাধ্যমে জনসেবাকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী সরকারের সকল অর্জন ও সফলতাকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমাদের দেশের জন্য এখন প্রয়োজন দ্রুত শিল্প বিনিয়োগ। সে জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ। অবকাঠামোগত সুবিধা, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং শিল্প জ্বালানীর ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ জরুরি। বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট করে যারা শিল্প স্থাপন এবং নিরবচ্ছিন্ন শিল্প চালানোর ক্ষেত্রে ক্যাপটিভ খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করতে চায় তাঁদের উদ্দেশ্য কি? শিল্প নির্মাণে নতুন জায়গার ব্যবস্থা না করে বিদ্যমান সুযোগ বন্ধকরে উন্নয়নের ধারা বন্ধ করতে কে বা কারা ষড়যন্ত্র করছে? তাদের উদ্দেশ্য কি? কার ষড়যন্ত্র তারা বাস্তবায়ন করছে? বর্তমান সময়ে ঘরে বাইরে সর্বত্র ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। হালকাভাবে বিষয়গুলোকে উড়িয়ে দেয়া উচিত নয়।
আমি আশা করছি সরকারের চলমান সফলতাকে নষ্ট না করে প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করা উচিত। জনবান্ধব দক্ষ জনশক্তি ও সঠিক সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ভীশন ২০৪২ বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব। সময়ের মধ্যেই সময়ের কাজ করা উচিত। কাজেই সময় থাকতেই সাধু সাবধান।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধফেলানী
পরবর্তী নিবন্ধসাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি