নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে লেখা নিবন্ধে সরকারের বিরুদ্ধে করা বেশ কিছু অভিযোগের জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নোবেল পুরস্কার নিয়ে ইউনূসের প্রতি ‘জেলাসি’ থাকার যে মন্তব্য ওই নিবন্ধে করা হয়েছে, সে প্রসঙ্গ ধরে সরকারপ্রধান বলেছেন, ওখানে লিখেছে নোবেল প্রাইজের জন্য নাকি তার সাথে আমার… আমার সাথে কারও দ্বন্দ্ব নাই, আর জীবনেও নোবেল প্রাইজের জন্য আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই। কারণ, আমার লবিস্ট রাখার মতো টাকাও নাই, পয়সাও নেই। আর আমি কখনো এটা চাইওনি। ভারত সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে গতকাল মঙ্গলবার গণভবনে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে টাইম ম্যাগাজিনের ওই নিবন্ধের প্রসঙ্গ টেনে প্রশ্ন করা করা হয় প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, অধ্যাপক ইউনূস পয়সা খরচ করে এসব লেখাচ্ছেন। এর আগে বিবৃতির কথা বলে অনেকের নামে বিজ্ঞাপন ছাপিয়েছেন।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির জন্য শেখ হাসিনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার যে আলোচনা উঠেছিল, সে কথাও এ প্রসঙ্গে বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, হ্যাঁ, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সই হওয়ার পরে দেশে–বিদেশে অনেকে আমার জন্য লিখেছে। তো, আমি তো কখনো তদবির করতে যাইনি, কারও কাছে বলতেও যাইনি। কী পেলাম, কী পেলাম না, এগুলা আমার মাথার মধ্যেও নাই। খবর বিডিনিউজের।
শান্তিচুক্তি হওয়ার পর ওই আলোচনা ওঠার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীতে যত শান্তিচুক্তি হয়েছে, কয়টা অস্ত্রধারী আত্মসমর্পণ করেছে? আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু শান্তিচুক্তিই করিনি, এক হাজার ৮০০ জন তাদের অস্ত্রধারী ক্যাডার তারা আমার কাছে অস্ত্র সারেন্ডার করেছে। আমি তাদের সকলকে সামাজিকভাবে, আর্থিকভাবে পুনর্বাসন করেছি। ৬৪ হাজার শরণার্থী ছিল ভারতে, তাদেরকে আমি ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করেছি।
বিদেশে অনেকে প্রস্তাব দিলেও ছুটে যাননি বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার কাছে অনেকে আসছে, আমি বললাম যে, আমার পুরস্কারের দরকার নাই। আর এই পুরস্কার আন্তর্জাতিকভাবে যারা পায়, এখানে তাদের কতটুকু অবদান সেটা না, এখানে আলাদা রাজনৈতিক একটা উদ্দেশ্য থাকে। কাজেই ওর মধ্যে আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই। আর বলে দিল, এর জন্য নাকি আমি উনার বিষয়ে জেলাস।
বিতর্কের চ্যালেঞ্জ : গণমাধ্যমে আসা অভিযোগের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের আদলে আলোচনায় আসার চ্যালেঞ্জ অধ্যাপক ইউনূসকে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, উনাকে জেলাসি করার কী আছে? সে আসুক না, মাঠে আসুক, চলুক আমার সাথে। আমেরিকায় ডিবেট হয় না… আসুক, কথা বলব।
সরকারপ্রধান বলেন, শেখ হাসিনা কারও সাথে জেলাসি করে না, শেখ হাসিনা জাতির পিতার মেয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। তো, এই জায়গাটাই কেউ আসতে পারবে না। আর সেটাই আমার গর্ব। প্রধানমন্ত্রী… এটা তো একটা সাময়িক ব্যাপার। কিন্তু আমি তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মেয়ে। আমি দেশও বেচি না, দেশের স্বার্থও বেচি না। আমি সবসময় দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চলি। তার জন্য আমি একবার ক্ষমতায় আসতেও পারিনি, তাতে কিচ্ছু আসে যায় নাই। আমার দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষা, দেশের মানুষের মাথা যেন উঁচু থাকে, আমার সরকারের সেটাই কাজ। আমি এর–ওর কাছে ধরনা দিয়ে বেড়াই না।
গ্রামীণ ব্যাংক চালাতে আর্থিকসহ নানা সুবিধা ইউনূসকে দেওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওয়াশিংটনে তার মাইক্রোক্রেডিট সামিটে কেউ অংশগ্রহণ করে না। আমি গিয়েছি, হিলারি ক্লিনটন ছিল, কুইন সোফিয়া আসছে, আমরা তাকে খুবই প্রমোট করেছি এটা ঠিক। কথাটা হচ্ছে, উপকারীরে বাঘে খায়। এখন উনার পয়সা আছে, উনি লেখাচ্ছেন। কতজন নোবেল লরিয়েটসহ যে বিবৃতিটা লেখালেন, এই বিবৃতিটা কি বিবৃতি? এটা তো বিজ্ঞাপন। উনি যদি এত পপুলার হবে, বিজ্ঞাপন দিয়ে এতজনের নাম ছাপাতে হবে কেন? তার জন্য সারা পৃথিবী ঝাঁপিয়ে পড়বে। কই একজনও তো কেউ বলল না।
রাজনীতিতে তার ব্যর্থতার দায় কি আমার? : এক–এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়েও শেখ হাসিনার সঙ্গে বিরোধ হওয়ার কথা বলা হয়েছে টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে। ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে সেখানে লেখার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক দল করতে গিয়ে ব্যর্থ হলো কেন? সে যদি গ্রামের মানুষকে এত কিছু দিয়ে থাকে, সেই গ্রামের মানুষতো ঝাঁপিয়ে আসবে। আসেনি কেন? কারণ সুদের চাপে তারা মৃতপ্রায় ছিল। সেজন্য তাকে কেউ সাড়া দেয়নি। সেখানে সে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায়িত্ব কি আমার? আমি তো তখন জেলে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাকে অ্যারেস্ট করার পরে তিনি তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং প্রেসিডেন্টকে এ ডাবল প্লাস দিয়ে আসছে। আমার বিরুদ্ধে তো একটার পর একটা মামলা হচ্ছে। আমি যখন বিদেশে, আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছিল।
বিদেশে ইউনূসের বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে বিদেশে এত বিনিয়োগ করে আসছে, টাকাটা কোত্থেকে আসছে? কীভাবে কামাই করেছে এই টাকাটা? এটার বিনিয়োগ কী করে হলো? এই প্রশ্নটা কি কেউ করেছে কখনো? কীসের টাকা? সেই জবাবটা দিক। একটা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরি করা অবস্থায় সে বিদেশে ব্যবসা করে। আমাদের আইন কী বলে? তারপরও আমরা সবাই মিলেই তাকে তুলেছি এটা ঠিক। এখন সব কিছুর দোষ আমার।
সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষে লেখে কীভাবে : শ্রম আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে টাইম ম্যাগাজিনে প্রতিবেদন ছাপানো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এখন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি সে। একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে এত কথা লেখে কীভাবে, ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেন। কনভিক্টেড লেবার কোর্টে, সরকারের কোর্ট না, লেবার কোর্টে। আইএলও কনভেনশন, প্রটোকলে আমরা স্বাক্ষর করেছি, আমরা শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করতে বাধ্য। এখানে আমাদের কিছু করার নাই।
শ্রম আদালতের মামলায় ইউনূসের দণ্ডিত হওয়ার পেছনে সরকারের ভূমিকা নেই বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মামলা করেছে তার লেবাররা। প্রমোশন চেয়েছে বরখাস্ত করেছে। তারা এরপর প্রত্যেকটা জায়গায় মামলা করেছে। আমি তো জানতামও না যে এটা। আর লেবার কোর্টের মামলায় শাস্তি পেয়েছে। তো, লেবারদের কি কোনো অধিকার নাই? যারা এত লেবার নিয়ে কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে, এত কিছু বলে, তারা কোথায় এখন? তারা কি এই লেবারদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে? দাঁড়ায় নাই।
শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকা–ইউরোপে কেউ ট্যাঙ ফাঁকি দিলে তার সম্পত্তি সাথে সাথে বাজেয়াপ্ত করে বিক্রি করে দেবে। এটাই তাদের নিয়ম। সেটা দেখেন না কেন? প্রতিবার ট্যাঙ ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবার মামলা করে তার কাছ থেকে ট্যাঙ আদায় করতে হচ্ছে। যারা লিখেছে, তারা এই অনুসন্ধানটা করুক।
ইউনূসের বিরুদ্ধে কখনো সরকার লাগেনি বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জেনারেল এরশাদের আমলে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর ইউনূসকে এনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক করা হয়েছিল। তিনি এমডি হিসেবে চাকরি করেছেন, বেতন তুলেছেন। আর গ্রামীণ ব্যাংকটা হচ্ছে সরকারের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। ওই টাকা, বেতন কিন্তু সরকার দিত। বাইরে যেতে হলে সরকারের জিও নিয়ে যেতে হত। সেই চাকরিরত অবস্থায় নিজে এমনভাবে প্রচার করেছেন, যেন উনার নিজেরই করা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকের আইনে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এমডি থাকার বিধান থাকলেও ইউনূস আইনভঙ্গ করে আরও ১০ বছর ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিষয়টি নজরে আনলে সরকার পদক্ষেপ নেয়। আমাদের তখনকার অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী তাকে রিকোয়েস্ট করেছিলেন যে, আপনার তো বয়স হয়ে গেছে, ইতোমধ্যে ১০ বছরের বেশি আপনি এখানে ইলিগ্যালি আছেন, আপনি এখানে উপদেষ্টা হিসাবে থাকেন।
কিন্তু ইউনূস সেটা না মেনে আদালতে গিয়ে হেরেছেন বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তিনি এমডি পদ ছাড়বেন না। এমডি পদ তাকে রাখতেই হবে। ড. ইউনূস কিন্তু আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে, অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন। এই কথাটা তো সেই পত্রিকাওয়ালা লেখেনি। দুটা মামলা করে। দুইটা মামলায়ই হেরে যায়।
সরকারপ্রধান বলেন, ১৯৯৮–৯৯ সালের দিকে গ্রামীণ ব্যাংক লোকসান করতে থাকায় প্রতিষ্ঠানকে চালু রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে ৪০০ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। এরপর তিনি প্রস্তাব দিলেন যে, একটা ফোনের ব্যবসা পেলে এর যে মুনাফাটা হবে, সেটা গ্রামীণ ব্যাংকে জমা হবে এবং সেটা দিয়ে ব্যাংক চলবে। তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত, আজ পর্যন্ত গ্রামীণফোনের একটি টাকাও গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে কিনা। দেওয়া কিন্তু হয়নি। বিদেশ থেকে আসা অনুদানের টাকা গ্রামীণ ব্যাংককে না দিয়ে ইউনূস নিজে ব্যবসা করেছেন বলে অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, তার কয়টা টাকা গ্রামীণ ব্যাংকে গেছে? প্রত্যেকটা সময় ওইটা দিয়ে ব্যবসা খুলে ব্যবসা করেছেন, কিন্তু কোনো ট্যাঙ দেননি। সে যে ট্যাঙ ফাঁকি দিয়েছে, সে তো নিজেই প্রমাণ দিয়েছে। কারণ, যখনই মামলা হয়েছে কিছু টাকা শোধ দিয়ে বসে আছে। যখনই কিছুটা শোধ দিল, তখন তো প্রমাণ হয়ে গেল যে, সে ট্যাঙ ফাঁকি দেয়। এমনকি গ্রামীণফোনের ক্ষেত্রে তার কাছ থেকে কয়েক দফায় টাকা আদায় করা হয়েছিল।
২০০৬ সাল থেকে শ্রমিকদের কল্যাণ ফান্ড থেকে ইউনূস একটি পয়সাও দেননি অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন লেবাররা মামলা করেছে, মামলা কিন্তু সরকার করেনি। লেবাররা লেবার কোর্টে মামলা করেছে, সেই মামলায় সে শাস্তি পেয়েছে। এখানে আমার কি দোষ? বরং আজকে তিনি যেখানে উঠেছেন, সেখানে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা তো আমিই করেছিলাম। তার মাইক্রোক্রেডিট সামিট, মাইক্রোক্রেডিট ইন্টারন্যাশনালি খুব গ্রহণযোগ্য ছিল না। আমি কো–চেয়ার হিসাবে অংশগ্রহণ করি, জাতিসংঘে প্রস্তাব আনি এবং আমি সবাইকে বোঝাই; আমি ভাবতাম যে এটা বোধ হয় খুব ভালো, মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করে।
শেখ হাসিনা বলেন, পরবর্তীতে দেখলাম, এটা দারিদ্র্যমুক্ত না, এটা দারিদ্র্য লালন পালন করে। ওই দরিদ্র মানুষগুলি দিন–রাত কাজ করার পর যে উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়। প্রথম সুদ যখন দিতে পারে না, আরেকটা লোন দিয়ে আগের লোন পূরণ করে, এরপর দ্বিগুণ হারে সুদ পড়ল, এই রকম করতে করতে ৪০–৪৫ ভাগ সুদ দিতে হত তাদের। যশোরের যে এলাকায় হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে মাইক্রোক্রেডিট দিয়েছিল, সেই পরিবারগুলি কোথায় এখন? খোঁজ করেন। জমিজমা সব বিক্রি করে ওখান থেকে তারা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়, অনেকে আত্মহত্যা করেছে এই সুদের চাপে।