যে কোন ডিসকোর্স তৈরি হতে থাকে সে সমাজ রাষ্ট্র বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা – ভাবনা কতটা এগিয়ে এবং কতটা পশ্চাৎপদ। যদি চিন্তকদের মনে এ–ই প্রশ্নের উদয় ঘটে যে আমাদের পূর্বের ডিসকোর্সে ফেলে আসা অনেক অগ্রবর্তী সূচক ফেলে আসা হয়েছে সেখানে নতুন পাল্টা একটা ডিসকোর্স তৈরি কিংবা বিনির্মাণ হতে–ই পারে। ইউরোপীয় কিংবা পাশ্চাত্য সমাজ সভ্যতার ঘটক – অনুঘটকগুলো এভাবেই এগিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
প্রতিটি ডিসকোর্স ফ্রেমে একটা জনমত বাছাইয়ের সুযোগ থাকে। এখন ভাবতে হবে আগের ডিসকোর্স ভেঙে – গুড়িয়ে দিয়ে আমরা কি নতুন নির্মাণে হাত দেব নাকি যেটি চলমান সেটি বিনির্মিত হবে। সাহিত্যের দর্শনগুলোতে একেক সময় একেক রেফেরেন্স বা সূত্র উঠে আসে। সেটি সর্বদা ভাষাচিন্তা, বিষয় কাঠামো –কে আপডেট করার জন্য। চিন্তা সবসময় অংশীমূলক। একজন মূল চিন্তক হলেও অন্যান্যরা দেশ –কাল যুক্তিতর্কের নিরিখে তাতে মতামত দিয়ে ভালো –মন্দ বিচার করে সর্ব সিদ্ধান্ত উপনীত হয়। যারা দীর্ঘকাল সমাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ঘটমান বিষয়াবলীর প্রতি সূতীক্ষ্ম নজর রাখে, তাঁরা নিছক খেলো নয়। তাঁদের ভাবনা চিন্তার মুহূর্তগুলোর মূল্য আছে। একদম অর্বাচীন চিন্তা কিংবা অপরিণামদর্শী অথবা উড়নচণ্ডী কিছু নেতিবাচক শব্দ দিয়ে তাকে উপর্যুপরি আঘাত করা যায় কিন্তু বিপক্ষের সমর্থনে সাক্ষীসাবুদসহ যৌক্তিক চিন্তা উপস্থিত করতে হয়। একাংশের চিন্তা খাটো হতে–ই পারে, আর খাটো হলেও দশক –উত্তর তার প্রভাব কীভাবে চিন্তার কাঠামো জুড়ে থাকে! মুখে সাফাইসাক্ষী দেওয়া যায়। দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত একটা দর্শনকে উড়িয়ে –গুড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ধরুণ, একটা দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি জনজীবনে বিপর্যয় বয়ে নিয়ে এলো, তাকে প্রমাণস্বরূপ উপস্থিত করুন। দিস্তার পর দিস্তা গবেষণা প্রবন্ধ – নিবন্ধ, সেমিনার সিম্পোজিয়াম কম তো হয় নি। এ–সব কী নিছকই বাচ্চাদের গেমিংস বা লুডুখেলা! একটা গ্রুপ ডিস্কাশনে খারাপ ভালো, মেধাবী অমেধাবী বা অংশত কম মেধাবী থাকতেই পারে, তা–ই বলে উমুক পরিণত মেধাবী, তমুক খুব ব্রিলিয়ান্ট নয়, এটি বলে চলমান একটা ডিসকোর্স–কে খারিজ করা যায় না।
ভাঙনের আওয়াজ একজন ব্যক্তি পেলে অপরাপর ব্যক্তিবর্গও পেতে পারে। আর অসুখের মতো ভাঙনেরও প্রতিষেধক আছে। ডিসকোর্স – এর সবটা মন্দ নয়, কিংবা অগ্রহণযোগ্য নয়। যেটি প্রস্তুত হয়েছে সমাজ রাষ্ট্রের বাস্তবতা থেকে সেটির সম্মুখে এগিয়ে যাবার কোন ক্ষত তৈরী হলে নিরাময় হতে পারে। এজন্যই আছে সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত্বের ইতিহাস ও গতি প্রকৃতি।
গত শতকের ৯০ এর দশকে উত্তর – আধুনিক এ–ই নতুন একটা ডিস্কোর্স এসেছে। ইউরোপীয় সাহিত্য দর্শনের বিপক্ষে এবং সে–সব উঁচু সাহিত্যিক দার্শনিক ক্ষমতা কেন্দ্রিক কাঠামো ভাঙার অভিপ্রায়ে। যে কেউ নিজস্ব সাংস্কৃতিক ইতিহাস এর জায়গা থেকে ইতিবাচক বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে, নিজের সাংস্কৃতিক জায়গা তৈরি করতে সময় লাগে না।
শুধু নিজের দর্শন – ভাবনাটা সাহস করে উপস্থাপন করতে হয়। কবি আল মাহমুদ একটা পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন; সাহিত্যের জন্য আমরা নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইতিহাস বিবেচনায় একটা ভাষা তৈরি করে দিয়েছি। বলা যায় সেটি ঔপনিবেশিক হেজেমনির বিপরীতে একটা শক্ত কাঠামো। কারণ এই ভাষাতে রয়েছে সংগ্রামমুখর মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্য ও নিম্নবর্গের মানুষের শক্তি। এই বিষয়গুলো নিয়ে ১৯৭৮ সালে লেখা এডওয়ার্ড ডব্লিউ. সাঈদ ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতন্ত্র বলি বা পাচ্যতত্ত্ব বলি, প্রাচ্য নিয়ে পাশ্চাত্যের চিন্তা দর্শনের জায়গাটা পরিষ্কার হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নতুন প্রকল্প কতটা প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলবে। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ এতে কতটা ফলপ্রসু হবে। যদি প্রাচ্যবাদ পাঠ করে প্রাচ্য জনগোষ্ঠী সচেতন হ‘য়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিকতন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাবে, এজন্য সাঈদ সাম্রাজ্যবাদীদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেছিল।
পশ্চিমাদের সমস্ত কৌশলগত পরিকল্পিত দর্শন ছিলো আমাদের প্রাচ্য মনোজগত অধীনস্থ করে রাখা। মোট কথা শিক্ষা সংস্কৃতি ইতিহাস চেতনা সর্বোপরি জ্ঞানভিত্তিক চিন্তার জায়গাকে সীল দিয়ে চিরতরে রুদ্ধ করে দেয়া। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দুর্বল দেশের উঠতি বুদ্ধিজীবীতার জায়গাকে সংকোচিত করা কিংবা শেষ করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবীদের স্বচিন্তন ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সৃজনশীল প্রপঞ্চকে সমূলে হত্যা করা। অস্ত্র কেনাবেচার মতো বড় অংকের প্রলোভন দেখিয়ে বুদ্ধিজীবীদের নিজেদের কাজে লাগিয়েছে সাম্রাজ্যবাদীরা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন খোদ মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চম্সকি। মূলতঃ তাঁর কাজ ভাষা নিয়ে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন নিয়ে চমস্কির বক্তব্য ছিলো পরিষ্কার। সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখে। তিনি বলেন, ভাষা এমন এক শক্তিশালী মাধ্যম যা চিন্তার জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। আদর্শিকভাবে এনার্কোসিন্ডিক্যালিজম ও লিবারেটিয়ান সোশ্যালিজমের সমর্থক সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণ বয়স থেকে সোচ্চার। এ–সব বিষয়ে সচেতন থেকে প্রতিবাদ করার বুদ্ধিজীবী কমে আসছে। ডিপস্টেট এর মতো জায়ান্ট অদৃশ্য ভাবনাকে মোকাবিলার জন্য দরকার এশিয়া অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞানের ব্যবহার। যদিও বিশ্বের তাবড় তাবড় বুদ্ধিজীবীদের এক দাঁতের বুদ্ধি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনুপস্থিত। না হলে অদৃশ্য চিন্তার একটা ডিপস্টেট ধারণা কীভাবে বিরাজমান রাষ্টীয় কাঠামো ভেঙে তছনছ করে দিতে পারে!
উত্তর আধুনিকতা স্থানিক মানুষের জীবন ধারণের সংস্কৃতি, স্বপ্ন, সুন্দর ও দর্শনের ফায়সালা। অবহেলায় অনাদরে পড়ে থাকা কিংবা ঘুমিয়ে থাকা একদম সাধারণ জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষের সাহিত্যিক মুক্তির বীজতলা উত্তর আধুনিকতা। উপরতলার সাহিত্যের বিপরীতে খেটে – খাওয়া মানুষের জীবন যাপন – আনন্দ – বেদনার অংশী হতে চায় এ–ই মানুষগুলো। এতে সামপ্রদায়িকতা কোথায়! এটি তাদের অধিকারও বটে। এভাবেই যদি সাহিত্য বিকশিত হয়, সমাজ চিন্তা এগিয়ে যায় সেখানে পাশ্চাত্যের বিপরীতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র সবল হতে পারে। মানুষের যাবতীয় সাংস্কৃতিক আচরণে ধর্মও আসতে পারে। ধর্মান্ধতা এবং উগ্র সামপ্রদায়িকতা না আসলেই হলো। সাহিত্য ও সমাজচিন্তা আকাশ থেকে নামে না। মানুষের যাপিত জীবনের আলেখ্যদর্শন–ই সাহিত্য। সমাজ সামগ্রিক পরিস্থিতি এগিয়ে দেয় সাহিত্য –কে। আধুনিক সাহিত্যের নৈরাজ্যের বিপরীতে স্থানিক সাহিত্যের বিনির্মাণে নব বিষয়ের উদ্বোধন একটা জাতির সাহিত্যিক চেহারাকে সামনে নিয়ে আসে।
নব্বুইয়ের উত্তর আধুনিক আন্দোলনের পরপরই অতিভক্তি সাহিত্যসেবীদের একটা অংশ এটিকে সামপ্রদায়িক লেবাস দিতে চেষ্টা করেছে বহুবার। কিন্তু তাদের আশায় গুড়েবালি। বরং সত্য ও সুন্দর যে দর্শন তা ভেসে উঠেছে সর্বত্র। একটা অংশ এখনও তৎপর কীভাবে উত্তর আধুনিকতার মধ্যে সামপ্রদায়িক বিষবাষ্প ঢুকাবে, তা নিয়ে হরহামেশা তৎপর রয়েছে। উত্তর আধুনিকতা এতদিন চেয়ে এসেছে স্থানিক সামাজিক চিরায়ত বিশ্বাস ইতিহাস ঐতিহ্যের বিনির্মাণ। সময়ের দাবীতে এতে সমকাল এবং রাজনৈতিক জিজ্ঞাসার আলোকায়ন হতেই হবে। স্থানিক থেকে বৈশ্বিক পথে যাত্রা উত্তর আধুনিকতার ভেতর দিয়েও হতে পারে। যে পশ্চিমা উত্তরাধুনিকতা, যাতে আছে সাহিত্যিক উল্লম্ফন সে পথে উত্তর আধুনিকতা বিবেচ্য কখনোই হবে না। উত্তর আধুনিকতার সাহিত্য দর্শন ও অনুভূতির জায়গা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। উত্তর আধুনিকতার ইতিবাচক রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি হলে, সংকট অনেকাংশে কমে যাবে। শুধু সাহিত্যের ভাষা ও ঐতিহ্য ইতিহাস নয় প্রাচ্যকে নতুন রাজনৈতিক জায়গায় দাঁড় করাতে হবে নতুন রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে। স্বতন্ত্র চিন্তার দৃষ্টভঙ্গিকে ঋজুভাব সটানভাবে দাঁড় করানো গেলে নগ্ন ও অবৈধ পুঁজিচক্র হয়তোবা নিষ্ক্রিয় হতে পারে।
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিপরীতে নিজের সংস্কৃতি ও ইতিহাস কে সাহসের সাথে সম্মুখে রাখলে গভীর দেশপ্রেম আসে, দেশ বন্দনা সৃষ্টি হয়। ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে ইতিবাচক রাজনৈতিক শক্তি সেখানে অন্যতম নিয়ামক শক্তি হবে। এদিকটায় পিছিয়ে থেকেছে এই চিন্তার ডিসকোর্স। যেহেতু এতে রাজনীতি ও সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হতে পারেনি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কবি।











