আমার পাশের বাড়ির এক ভদ্রলোক কানাডা প্রবাসী। ৫–৭ বছর পর পর যখন বাড়িতে আসতো হাবভাব দেখে মনে হতো সদ্য চাঁদ থেকে অবতরণ করেছেন। কথা বার্তায় একটা আভিজাত্য ভাব প্রকাশ করতেন। গ্রামের মানুষের সাথে একটু ডিস্টেন্স নিয়ে চলাফেরা করতেন। খবর নিয়ে জানতে পারি তিনি টরেন্টোতে ফ্ল্যাট বাড়ি ও গাড়ি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর স্ত্রী বাড়ির বেজমেন্টে ৫–৬ টা দুগ্ধ পোষ্য শিশু লালন পালন করেন এবং গত ১০–১৫ বছর যাবত তিনি এই কাজ করে কোনও রকমে প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছেন।
এমিরেটস এয়ারলাইন্সের এক ক্যাপ্টেন (পাইলট) মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করতেন। প্রায় ২৫ বছর পাইলটের চাকরি করেছেন। ভালো অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঢাকার লালমাটিয়ায় ৬ তলা বাড়ি করেছেন। আরো উন্নত জীবন ও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চাকরি ছেড়ে কানাডা ইমিগ্রেন্ট হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কানাডায় গিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন সন্তানদের ভালো স্কুল কলেজে লেখাপড়া করিয়েছেন। বড় মেয়ে কানাডায় বিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দিকে ভদ্রলোক কানাডায় কোনও জব করতেন না। জমানো টাকা ও ভাতা দিয়ে চলতেন। ৭–৮ বছর পর হাতে থাকা সব অর্থ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁর স্ত্রী একটা ইলেকট্রনিকস শোরুমে চাকরি নেন। এতেও সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য না আসায় ট্যাক্সি ক্যাব চালানো শুরু করেন। দেশে আসবেন কিনা জিজ্ঞেস করলে বলেন, বুঝেন ত বিমান ভাড়া অনেক টাকা। জোগাড় করতে পারলে যাবো। শুধু তিনি নন অনেকেই বিমান ভাড়া যোগাড় করতে না পারায় দেশে আসতে পারেন না।
আমার এক পরিচিতি ছেলে, অবিবাহিত। দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে মাঝারি মানের চাকরি করতো। পৈর্তৃকভাবে চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় সাত তলা বাড়ির মালিক। বাবার মাধ্যমে চট্টগ্রাম ক্লাবের মেম্বার। বাসায় বয়স্ক মা বাবা, প্রায় অসুস্থ থাকেন। দেশে ভালো লাগে না তাই আরো উন্নত জীবনের আশায় হঠাৎ করে কানাডা ইমিগ্রেন্ট হয়ে চলে যায়। ওখানে গিয়ে ছোটখাটো জব করে। ১৫০০ ডলারের মত বেতন পায়। কিন্তু এ টাকায় বাসা ভাড়া ও খেয়ে দেয়ে ভালো ভাবে চলতে পারে না। প্রতি মাসে দেশ থেকে ২০০০ ডলার নিতে হয়। ওখানে গাড়ি কিনেছে, বিভিন্ন দেশের অনেক বন্ধু বান্ধবী হয়েছে। অবিবাহিত বলে ক্যাসিনো ডিসকো বারে প্রতিদিন যাতায়াত করে সময় কাটানোর জন্য। রান্না করতে পারে না, তাই সবসময় হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করে। দেশে থাকা বাবা মাকে বলেছে চট্টগ্রামের বাড়ি বিক্রি করে কানাডায় চলে যেতে। বুঝলাম মা বাবা মারা গেলে দেশের সব সম্পত্তি বিক্রি করে কানাডায় নিয়ে যাবে।
কানাডায় স্নাতক পড়ুয়া এক ছাত্রের অভিভাবক গত ২ বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি পাঠিয়েছেন ছেলের লেখা পড়ার খরচের জন্য। ভদ্রলোক ক্ষোভের সাথে বলেন এতো টাকা লাগবে জানলে ছেলেকে বিদেশ পাঠাতেন না। তবে যেসব অভিভাবক লেখাপড়ার জন্য সন্তানকে আমেরিকা কানাডা পাঠান তারা হয়ত জানেন না, ঐসব দেশে ১২ ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া ফ্রি কিন্তু এরপর মোটা অংকের টিউশন ফি দিয়ে লেখাপড়া করতে হয়। যে কোন বিষয়ে অনার্স শেষ করতে হলে অন্তত কোটি টাকা খরচ করতে হয়। আর ডাক্তারি পড়তে হলে ২–৩ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারের যারা লেখাপড়া করার জন্য ঐসব দেশে যায় তাদের বেশিরভাগ অর্থ সংকটে পরে লেখাপড়া শেষ করতে পারে না। যারা খুব আগ্রহী তারাও সেমিস্টার গ্যাপ দিয়ে পার্ট টাইম চাকরি করে তারপর লেখাপড়া শেষ করে। আবার তদারকির কেউ না থাকায় অনেকে উঠতি বয়সের জোয়ারে নিজেকে ঠিক রাখতে না পারে মাদকে এডিকটেড হয়ে জীবন নষ্ট করে ফেলে। যা থেকে আর ফেরত আসতে পারে না। তবে স্কলারশিপ নিয়ে যারা যায় তাদের কথা ভিন্ন।
তবে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে না পারলেও রাষ্ট্র তার অভিবাসী নাগরিককেও খাইয়ে পরিয়ে এমন কি গাড়ি কিনতে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। ঐসব দেশে মর্টগেজের একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাড়ি গাড়ি ও আসবাবপত্র কেনা বেশ সহজ এবং প্রায় সবাই সেভাবেই কিনেন। আর বছরের পর বছর ধরে ঐ লোন শোধ করেন। এতে করে সবার হাতে তেমন একটা সারপ্লাস টাকা থাকে না। বলা যায় যা ইনকাম তার প্রায় সবই খরচ হয়ে যায়। ওখানে জীবন যাপনের ব্যয়ও অত্যধিক বেশি। তবে যারা কায়িক পরিশ্রমের কাজ যেমন প্লাম্বার মিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিশিয়ান, রং মিস্ত্রি, সেনিটারী মিস্ত্রি, রাজ মিস্ত্রি, টাইলস মিস্ত্রি, হাউজ কিপিং, অটোমোবাইল মিস্ত্রি বা ড্রাইভারের কাজ করেন তাদের আয় প্রচুর। ভালো অফিসিয়াল চাকরি বা কাজ করতে গেলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিপ্লোমা বা লেখাপড়া জানা থাকতে হয়। অর্থাৎ যে বিষয়ের চাকরি প্রার্থী তার উপর ন্যূনতম দক্ষতা না থাকলে চাকরি পাওয়া যায় না। আর ব্যবসা বাণিজ্য করতে হলে কোটি কোটি টাকা দরকার। সে সক্ষমতা না থাকায় বাইরের দেশ হতে আগত সবাই চাকরিকে বেছে নেয়। বিভিন্ন দেশ হতে প্রতি মাসে এতো লোক কানাডায় প্রবেশ করে যে বর্তমানে চাকরি ও বাসা ভাড়া পাওয়া দুষ্কর। ইমিগ্রেন্ট বা অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে প্রচুর বেকার। তাই এরা নানাবিধ অড জব করে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। অনেকে দলালের মাধ্যমে ২০–৩০ লাখ টাকা খরচ করে ভিজিট বা স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডায় এসে পলিটিক্যাল এসাইলেম চেয়ে রিফুজি হিসাবে থেকে যায়। ফলে তারা না পারে দেশে ফেরত যেতে, না পারে ভালো কিছু করতে।
যারা দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করে বেগম পাড়া গড়ে তুলেছেন আমি নিশ্চিত, সে টাকা তারা ভোগ করতে পারবে না। বাংলাদেশের আইন কানুনকে ফাঁকি দিয়ে টাকা পাচার করলেও কানাডা সরকারকে ব্যাংকে জমাকৃত টাকার পাই পাই হিসাব দিতে হবে এবং সে টাকা কখনোই ফেরত আনতে পারবে না।
আসলে উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে কানাডা আমেরিকা ও ইউরোপের জীবনযাত্রা বেশ কঠিন। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সব কাজ নিজেকে করতে হয়। কোন হেল্পিং হ্যান্ড নেই। ওখানে সবাই শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে। একটা বয়সের পর নিজের সন্তানও আলাদাভাবে থাকে। সেজন্য সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সারা সপ্তাহে যা কামাই করে তার পুরোটাই সাপ্তাহিক ছুটিতে বেড়িয়ে ও শপিং করে খরচ করে ফেলে। তারা নিজের শারীরিক ও মানসিক চাহিদাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। ফলে যার সাথে মতের মিল হয় তার সাথে লিভ টুগেদারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তবে ব্যতিক্রমও আছে। শারীরিক চাহিদার জন্য একসাথে থাকলেও মতের অমিল হলে দ্রুত আলাদা হয়ে যায়। আর লিভ টুগেদার করতে গিয়ে বা বিবাহিত জীবনে সন্তান জন্ম হলে তার সব দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করে। জন্মের পর থেকে বাচ্চারা ভাতা পায়। চিকিৎসা, ভরন পোষণ থেকে শুরু করে লেখাপড়া সবই সরকার বহন করে। তাই কেউ তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অর্থ সম্পদ রেখে যাওয়ার চিন্তা করে না। প্রায় সবাই একটা বয়সের পর বয়স্ক হোমে চলে যায়। ওখানে রাষ্ট্র তাদের জন্য থাকা খাওয়া চিকিৎসা ও নির্দিষ্ট অংকের ভাতাসহ যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা রেখেছে। সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে তার সব স্বাদ আহ্লাদ রাষ্ট্র পূরণ করে। অর্থাৎ ঐসব দেশে সামাজিক নিরাপত্তা অতুলনীয়। প্রায় সবাই গৃহপালিত পশু (কুকুর, বিড়াল) লালন পালন করে। কারণ সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবে আর কেউ না থাকায় গৃহপালিত পশুই তাদের সুখ দুঃখ ও চলাচলের একমাত্র সঙ্গী। বয়স্করা একাকীত্ব ও সময় কাটানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করেন ও ক্যাসিনোতে গিয়ে সময় কাটান। তাই যারা না জেনে না বুঝে এসব দেশে যেতে চান বা লেখাপড়ার জন্য সন্তানকে পাঠাতে চান, তারা ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিবেন। না হয় সারা জীবন পস্তাতে হবে। কারণ ওসব দেশে গিয়ে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে দেশে ফেরত আসা যে কোনো কারো পক্ষে কঠিন।
লেখক: প্রাবিন্ধক ও কলামিস্ট।