পরিবার–পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে ঈদ উৎসবে মেতে ওঠার আনন্দই আলাদা। সহজে কেউ হাতছাড়া করতে চান না এ সুযোগ। হাজারো ঝক্কি–ঝামেলা সত্ত্বেও নাড়ির টানে বাড়িমুখো হন সবাই। খালি বাসা–বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে ঈদের ছুটি কাটাতে ছুটে যান গ্রামের বাড়িতে। তাই ঈদের সময় অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায় নগরী। আর এই ফাঁকা নগরীতে হঠাৎ বেড়ে যায় গ্রিল কাটা পার্টির সদস্যদের অপতৎপরতা। পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় টহলে থাকলেও তালা ঝুলানো বাসায় গ্রিল কেটে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে অবাধে পালিয়ে যায় ওই চক্র। তাই ঈদের সময় গ্রিল কাটা পার্টিকে ঘিরে যত ভয় চট্টলাবাসীর।
অবশ্য এবারের ঈদে নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোর নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। ঈদে এবার আবাসিক এলাকাগুলোতে পাহারায় থাকবেন পুলিশ সদস্যরা। বাসা–বাড়ি ছাড়াও ঈদের ছুটিতে দোকানপাট, অফিস–আদালত, কল–কারখানা ও বিনোদন কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তায় বন্দর নগরীতে দুই হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকবেন। তবে পুলিশের বিশেষ নজরদারি থাকবে নগরীর ফাঁকা বাসা–বাড়ির দিকেই।
ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে। গত রোববার থেকে নগরবাসী গন্তব্যে যাওয়া শুরু করেছে। শহর ছাড়ার ক্ষেত্রে যানবাহনের ভিন্নতা থাকলেও সকলের গন্তব্য নিজ গ্রাম। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এবার নগরী থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শহর ছাড়বে। সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের ছুটিতে নগরী ফাঁকা থাকার কারণে বাসা–বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটতে পারে। অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ড তেমন হবে না। ঈদের দিন নগরীর নিরাপত্তায় বিশেষ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে পুলিশ ও র্যাব। এছাড়া ঈদের ছুটিতে ফাঁকা হয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম নগরীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বাড়ি ফেরার আনন্দের মাঝেও উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে ঘরমুখো মানুষের মনে। নগরীতে ৫৫টি সরকারি–বেসরকারি ব্যাংকের ৫শর বেশি শাখা রয়েছে। জুয়েলারি দোকানের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। ঈদের ছুটির কারণে ব্যাংক, শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মার্কেট ও অফিস আদালত বন্ধ থাকায় এ সময় নগরীতে ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সেই শঙ্কা কাজ করছে ঘরমুখো মানুষের মনে। তবে এবার ঈদের ছুটিতে ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা এড়াতে সতর্ক থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যে বাসাবাড়ির নিরাপত্তায় সক্রিয় থাকতে পুলিশ সদস্যদের সিএমপির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাড়তি নিরাপত্তায় মাঠে থাকছে ৩৫০ সদস্যের র্যাবের একটি দলসহ সোয়াত ও এপিবিএনের সদস্যরা।
সিএমপির অতিরিক্ত উপ–কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা আজাদীকে জানান, ঈদের ছুটিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা তারা করছেন না। তিনি বলেন, বড় কোনো অপরাধী নগরীতে ঢুকলেই আমাদের কাছে খবর চলে আসছে। তাই নগরী শান্ত থাকবে। ঈদের ছুটির কারণে নগরী ফাঁকা পেয়ে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, ছিনতাইকারীরা যাতে বেপরোয়া হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে।
সিএমপির বিভিন্ন থানার কর্মকর্তাগণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানান আজাদীকে। প্রতিটি থানা এলাকায় নিয়মিত টিমের পাশাপাশি অতিরিক্ত টিম নামানো হয়েছে। মোবাইল টিম, ফুট পেট্রল, মোটরসাইকেল পেট্রলের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ঈদের ছুটিতে এরা এলাকায় নিয়োজিত থাকবে।
সূত্র মতে, নগরীর ৩৪টি বড় ঈদ জামাতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। অন্যান্য ঈদ জামাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক ভাগ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর পয়েন্টগুলোতে মোতায়েন করা হবে। অপর দুই ভাগের মধ্যে এক ভাগ ঈদ জামাতের স্থানে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে এবং অপর ভাগ পুরো নগরে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে টহল দেবে। এছাড়া বিভিন্ন মার্কেট এলাকায় মোতায়েন করা পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন এলাকায় ঈদ জামাতে মোতায়েন করা হবে।
নগরীর নিরাপত্তা প্রসঙ্গে সিএমপির সহকারী কমিশনার একেএম মহিউদ্দিন সেলিম আজাদীকে বলেন, নগরবাসীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঈদ উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নগরীর সবগুলো আবাসিক এলাকায় পুলিশের টহল আরও জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে স্থানীয় থানা পুলিশকে। তিনি জানান, ঈদের জামাতসহ ঈদের পর পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশনে মোতায়েন থাকবে অতিরিক্ত পুলিশ। পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের উদ্যোগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নগর পুলিশের হিসেব মতে, চট্টগ্রামে সর্বাধিক ৭৪টি আবাসিক এলাকা আছে বায়েজিদ বোস্তামি থানা এলাকায়। এছাড়া আকবর শাহ থানায় ২৩টি, খুলশী থানায় ২২টি, পাঁচলাইশে ১৭টি, ডবলমুরিংয়ে ১৫টি, চকবাজারে আটটি, পতেঙ্গা, চান্দগাঁও ও পাহাড়তলীতে সাতটি করে, হালিশহরে পাঁচটি, বাকলিয়া, কর্ণফুলী, ইপিজেড ও সদরঘাট থানায় চারটি, বন্দর থানায় তিনটি ও কোতোয়ালী থানায় একটি আবাসিক এলাকা রয়েছে। এসব আবাসিক এলাকার বিভিন্ন কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে নির্ধারণ করা হচ্ছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঈদের ছুটিতে নগরীর নিরাপত্তা জোরদারে থানা পুলিশের বাইরে অতিরিক্ত আরও তিন থেকে চারশ পুলিশ ফোর্স মোতায়েন থাকবে। এছাড়া নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে নজরদারির পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
কোতোয়ালী থানার ওসি জাহিদুল কবীর আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। সেভাবে কাজ চলছে।
আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ারী উদ্দিন আকবর আজাদীকে জানান, বিভিন্ন আবাসিক এলাকার তালিকা করে সংশ্লিষ্ট সমিতির কর্মকর্তাদের পুলিশের নম্বর দেয়া হয়েছে। চুরি–ডাকাতি প্রতিরোধে যেকোনো সময় তাদের পুলিশের সহযোগিতা চাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একইভাবে ব্যাংকের শাখার তালিকা করে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে পুলিশ সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
চান্দগাঁও থানার ওসি সাখাওয়াত হোসাইন আজাদীকে জানান, ঈদ উপলক্ষে নগরীতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে সিএমপি। তারই অংশ হিসেবে তার থানা এলাকায় অলি–গলিতে বাড়ানো হয়েছে পুলিশের নিয়মিত টহল।