ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় তাৎপর্য

মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | বুধবার , ১২ মে, ২০২১ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যেক জাতির আনন্দ উৎসবের দিন রয়েছে মুসলমানদের আনন্দ উৎসবের দু’টি দিনের মধ্যে ঈদুল ফিতর এক অনন্য মর্যাদায় ঐতিহ্যমন্ডিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, প্রত্যেক জাতির আনন্দ উৎসবের দিন রয়েছে। আর এ দিনটি আমাদের ঈদ। (বোখারী ও মুসলিম)
ঈদ শব্দটি ‘আউদুন’ থেকে উদ্ভূত, আউদুন অর্থ ফিরে আসা, পুনঃপুনঃ আসা। ঈদ অর্থ খুশী, আনন্দ আমোদ, উৎসব ইত্যাদি। মুসলমানদের জাতীয় জীবনে খুশী ও আনন্দের সওগাত নিয়ে ঈদ বারবার আসে। ঈদুল ফিতর অর্থ হলো, উপবাস ভঙ্গকরণের আনন্দ। সুদীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালনার্থে এ দিনটিতে রোযা ভঙ্গ করে ঈদগাহে বা মসজিদে সমবেত হয়ে মহানন্দে যে দু’রাকাত নামায আদায় করে তা ঈদুল ফিতরের নামায। এ নামাযের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এতে আযান ও ইকামত নেই।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে যে, হযরত জাবের ইবনে সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সাথে একবার নয় দুইবার নয় (অনেকবার) দুই ঈদে সালাত আদায় করেছি, আযান ও ইক্বামত ছাড়া। (মুসলিম)
এ নামাযের আরো অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো খুতবার আগে এ নামায আদায় করা হয়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা দুই ঈদের সালাত খুতবার পূর্বে আদায় করতেন। (বুখারী ও মুসলিম)
ঈদের দিন মুসলিম মিল্লাতের জন্য সর্বদিক দিয়ে আনন্দ ও উৎসবের দিন। পরস্পর ভ্রাতৃত্ব ভালবাসার প্রীতি ও সৌহার্দ্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের অপূর্ব সম্মিলন ঈদুল ফিতর। এ দিন মুসলিম সমাজে বিভিন্নভাবে খুশী ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নতুন সুন্দর জামা কাপড় পরিধানে বন্ধু-বান্ধব, আপনজন, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন ও ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে পোশাক পরিচ্ছদ ও উপহার সামগ্রী বিতরণ বৈচিত্র্যময় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন, সন্তানদের জন্য খেলাধুলা ও আনন্দ বিনোদন ও উপহার বন্টনে উৎসব মুখর পরিবেশে নিজে আনন্দিত হওয়া ও অন্যজনকে আনন্দ দেয়া ইসলামের এক অনুপম শিক্ষা। ইসলাম পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ধনী-নির্ধন, আমীর- ফকিরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অন্যের সাথে বুক মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের যে অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, তা পৃথিবীর অন্যকোন ধর্মে পরিদৃষ্ট হয়না। ঈদুল ফিতরের নামাযের গুরুত্ব বর্ণনাতীত। ঈদ আসে সীমাহীন ভালোবাসা ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে। সেই ঈদকে যথার্থ মর্যাদায় উদ্‌যাপন করা, ঈদের পবিত্রতা রক্ষা করা, ঈদের নামায যথাযথভাবে আদায় করা, প্রত্যেক মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য। এ দিবসের আরো অসংখ্য ফজিলত হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যেমন- হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্‌ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে রাস্তা পরিবর্তন করতেন। অর্থাৎ গমনের সময় এক রাস্তা এবং প্রত্যাবর্তনের সময় ভিন্ন রাস্তা হয়ে আসতেন। (বুখারী)
রাস্তা পরিবর্তনের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসীন কেরাম বলেছেন, যেন উভয় রাস্তার বরকত অর্জিত হয়। উভয়দিকের বাসিন্দাদের সঙ্গে যেন মতবিনিময়ের সুযোগ হয়। উভয় রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়াতে ফকির মিসকিন, অনাথ, নিঃশ্ব-অসহায়, বঞ্চিতরা যেন দান-সাদকা, সাহায্য, সহযোগিতা লাভে ধন্য হয়। যাতায়াত পথে নিকটাত্মীয়দের কবরস্থান থাকলে তাও যিয়ারত করা যায়। উভয় রাস্তা যেন আমাদের ঈমান, নামায, ইবাদত, দান-সাদকা ইত্যাদির সাক্ষ্য হয়ে যায়।
ঈদের দিনে শুভেচ্ছা বিনিময়
ঈদের দিন মুসলমানদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ইসলামের প্রাচীনতম ঐতিহ্য। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- তাবিয়ী হযরত জুবায়র ইবনে নুফায়র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ ঈদের দিনে সাক্ষাৎ হলে একে অপরকে বলতেন আল্লাহ্‌ আমাদের ও আপনাদেরকে কবুল করুন।
ইসলামের প্রতিটি খুশী আনন্দ ইবাদত কেন্দ্রিক
আল্লাহ্‌ ও তদীয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের স্মরণ ব্যতিরেকে কোন প্রকার খুশী আনন্দ ইসলাম অনুমোদন করে না, এ জন্য ইসলামে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাতে নামাযের নির্দেশ রয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু’ রাকাত নামায আদায় করতেন। এর পূর্বে ও পরে কোন নামায আদায় করেননি। (বোখারী শরীফ)
ঈদের দিন গোসল করা সুন্নাত
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। দৈহিক পবিত্রতা অর্জনকে ইসলাম বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের দেহ মনে স্বস্থি বিরাজ করার জন্য ঈদের দিবসে গোসলের বিধানকে সুন্নাত ঘোষণা করেছেন। এরশাদ হয়েছে- হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (বায়হাক্বী শরীফ)
গুনাহ্‌ থেকে বিরত থাকার দিন মুমীনের ঈদের দিন
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেন, ১. যে দিন মুমীনের জীবন গুনাহ্‌ থেকে মুক্ত হবে, সেদিনটি হবে তার জন্য ঈদের দিন। ২. মুমীন যেদিন ঈমান সহকারে পরকালের সফর শুরু করবে, সেদিন হবে মুমীনের প্রকৃত ঈদের দিন। (ফকীহ্‌ আবুল লাইস, আনোয়ারুল বয়ান ৩য় খন্ড, পৃ. ১০২)
হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে ওমর এর ঈদ
আমীরুল মুমীনীন হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ঈদের দিনে নিজ পুত্র হযরত আবদুল্লাহকে পুরাতন কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখে কেঁদে দিলেন, পুত্র বললেন, আব্বাজান আপনি কেন কাঁদছেন? হযরত ফারুকে আজম বললেন, আজকের ঈদের দিনে অন্যান্য ছেলেরা যখন তোমাকে পুরাতন ছেঁড়া কাপড় দেখবে তখন তোমার অন্তর ভেঙ্গে যাবে। ছেলে জবাব দিলেন, অন্তর তো তারই ভেঙ্গে পড়বে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি, যে পিতামাতার অবাধ্য হয়েছে, আমি তো আশা রাখি আপনার সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমার আল্লাহও আমার উপর সন্তুষ্ট। এ কথা শুনে হযরত ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কেঁদে দিলেন, স্বীয় পুত্রকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন এবং তাঁর জন্য দুআ করলেন। (মোকাশেফাতুল কুলুব, পৃ. ৭১০)
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজের ঈদ
উঁচু মাপের বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব মুসলমানদের বাদশাহ্‌ আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.)’র কন্যাগণ ঈদের একদিন পূর্বে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন। আব্বাজান! কাল ঈদের দিন আমরা কোন কাপড় পরিধান করব! তিনি জবাব দিলেন, যে কাপড় তোমাদের পরিধানে আছে, তাই পরিধান করবে। তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ধুয়ে নিবে, আগামীকাল ঈদের দিন তা পরবে। আদরের মেয়েরা এতে দুঃখ পেল, প্রিয় পিতার নিকট আবেদন জানালো আপনি আমাদের জন্য নতুন কাপড় ব্যবস্থা করুন, হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) বললেন, ওহে আমার প্রিয় মেয়েরা শুনো! ঈদের দিন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী ও শুকরিয়া আদায় করার দিন, নতুন কাপড় পরিধান করা তো আবশ্যক নয়। মেয়েরা বললো, আপনার কথা সঠিক, কিন্তু প্রতিবেশী অন্যান্য মেয়েরা তো আমাদেরকে তিরস্কার করবে, তোমরা বাদশাহর মেয়ে আমিরুল মুমেনীন এর মেয়ে অথচ তোমরা পুরাতন কাপড় নিয়ে ঈদ উদযাপন করছো? এ কথা বলতে বলতে মেয়েদের চোখে কান্না এসে গেল। প্রিয় কন্যাদের কথা শুনে আমিরুল মুমেনীনের অন্তরাত্মা কোমল ও অশ্রুসজল হয়ে পড়লো, তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোষাধ্যক্ষকে ডাকলেন, বললেন, আমাকে আগামী এক মাসের বেতন সম্মানী অগ্রিম দিন! খোদাভীরু মুত্তাকী কোষাধ্যক্ষ উত্তর দিলেন, আমিরুল মুমেনীন আপনি কি নিশ্চিত যে, আগামী একমাস পর্যন্ত আপনি জীবিত থাকবেন, আমিরুল মুমেনীন বলে উঠলেন, আল্লাহ্‌ তোমাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন। তুমি সত্য কথা বলেছ, আমিরুল মুমেনীন নিজ কন্যাদের বললেন, হে প্রিয় কন্যাগণ আল্লাহ্‌ ও রসূলের সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের খুশী আনন্দকে তোমরা উৎসর্গ করো। সকলেই তাই করলেন, এ ছিল ইসলামের ইতিহাসে আমিরুল মুমীনদের শাসনামালের সোনালী অধ্যায়। মহান আল্লাহ ঈদের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবন করার তাওফিক দিন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআহমদ মমতাজ : আরেকটি অমূল্য প্রাণ ঝরে গেল মহামারির ঝড়ে
পরবর্তী নিবন্ধঅধ্যাপক শফিকুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু