পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলিম জাতির অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। প্রতি চান্দ্রমাসের ১০ জিলহজ্ব ঈদুল আজহা বিশ্ব মুসলিমের কাছে কোরবানির অফুরন্ত আনন্দের সওগাত ও ত্যাগের মহিমা নিয়ে আসে। ঈদুল আজহা খোদাভক্তি, আত্নত্যাগ ও আত্নশুদ্ধির মহিমায় ভাস্বর। এ দিনে বিশ্বের লাখো–কোটি মুসলিমগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহান স্রষ্টার নৈকট্য লাভের উদ্দেশে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ.)- এর অতুলনীয় ত্যাগ ও কোরবানির আদর্শকে গভীর দ্ধাভরে স্মরণ করে।
‘ঈদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আনন্দ বা উৎসব। আর ‘আজহা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ত্যাগ। পরিভাষায়–কোরবানের উৎসর্গকৃত পশু যা এক আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার যে সার্থক প্রচেষ্টার আর্থিক আনন্দ তাই ঈদুল আজহা। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) মহান অল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি বিধান ও তাঁর নির্দেশ পালনে আত্নত্যাগের যে নজির স্থাপন করেছিলেন সেই মহান ঘটনার স্মারক ঈদুল আজহা। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও তাঁর ওপর আত্মসমর্পণ কতোটা ত্যাগ দাবি করে তার প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)- এর নিষ্ঠা ও আত্নত্যাগের এ ঘটনায়।
হজরত ইবরাহিম (আ.)- এর প্রথম স্ত্রী সারার গর্ভে দীর্ঘদিনেও কোনো সন্তান না হওয়ায় হজরত ইবরাহিম (আ.) বার্ধক্য বয়সে মিসরে এসে হাজেরা নামে এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং হাজেরাকে নিয়ে তাঁর মূল বাসভূমি কানআনে তিনি ফিরে আসেন। ইবরাহিম (আ.) মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে একটি পুত্র সন্তানের জন্যে দোয়া করলে আল্লাহতায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করেন। এরপর ছিয়াশি বছর বয়সে হযরত ইবরাহিম (আ.)- এর একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। ইতোপূর্বে হযরত ইবরাহিম (আ.) মহান প্রভুর দেয়া একাধিক পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। যেমন– আগুনে নিক্ষেপ করার পরীক্ষা। তারপর দেশান্তর হওয়ার পরীক্ষা। এরপর বিবির ওপর জালেম বাদশার লোলুপ দৃষ্টির পরীক্ষা। যাওবা বুড়ো বয়সে একটি সন্তান দেয়া হয় তাঁকে এবং তাঁর মাকে মরু বিয়াবানে বনবাস দেয়ার পরীক্ষা হয় আবার। মহান প্রভু তাঁর প্রিয় বন্ধুকে আরো যাচাই–বাছাই করার জন্যে সর্বশেষ কঠিন পরীক্ষা করলেন। তা হচ্ছে, শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.) যখন পিতা–মাতার সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রকে নিজহাতে জবেহ করছেন। নবীর স্বপ্ন নিছক স্বপ্ন নয়, বাস্তব। তাই তিনি কিশোর ইসমাঈলকে বিষয়টি বললেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে এর বিবরণ এসেছে এভাবে, ইবরাহিম বললেন– হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কী? ইসমাঈল বললেন– হে আমার পিতা! আপনাকে স্বপ্নযোগে যা আদেশ করা হয়েছে তা পালন করুন। আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন ইনশাআল্লাহ। – (সুরা সাফফাত: ১০২)। তখন হযরত ইবরাহিম (আ.) পুত্রের উত্তর শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে কোরবানির উদ্দেশে পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে মক্কার অদূরে মিনায় পৌঁছলেন। ইবরাহিম (আ.) তাঁর পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন। এ সময় কিশোর ইসমাঈল তাঁর পিতাকে বললেন– হে আব্বাজান! আমার হাত পা মজবুত করে বেঁধে নিন। যাতে করে আমি নড়াচড়া না করি। আপনার পোষাক সামলে নিন, যেন রক্তের ছিটা তাতে না লাগে। যা দেখে আমার মা অস্থির হয়ে যেতে পারেন। আর ছুরিটি ধার করে নিন। যাতে আমার কষ্ট কম হয়। কেননা, মৃত্যু অত্যন্ত কঠিন। আম্মাকে আমার সালাম জানাবেন। আর আমার জামাটি মায়ের কাছে নিয়ে যাবেন। এতে তিনি কিছুটা শান্তি পাবেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন ইসমাঈলকে কোরবানি দেয়ার পক্রিয়া শুরু করলেন, তখন আকাশ–বাতাস প্রকম্পিত হয়ে গায়েবি আওয়াজের মাধ্যমে ইবরাহিম (আ.)- কে অবহিত করা হলো– হে ইবরাহিম! তুমি ক্ষান্ত হও, তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যিই বাস্তবায়ন করেছো।
তখন তিনি উপরের দিকে তাকালে হজরত জিবরাঈলকে একটি দুম্বা নিয়ে দাঁড়ানো দেখলেন। এ জান্নাতি দুম্বা ইবরাহিম (আ.)-কে দেয়া হলে তিনি আল্লাহর নির্দেশক্রমে পুত্রের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি করলেন। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আমি এভাবে নেক্কার লোকদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা।-(সুরা সাফ্ফাত: ১০৫–১০৬)। সব ক’টি পরীক্ষা ইবরাহিম (আ.) সাফল্যের সঙ্গে পাশ করেন। উত্তীর্ণ হন ত্যাগ এবং তিতিক্ষার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে। পিতা–পুত্রের সুমহান আত্মত্যাগের ফলে প্রতিষ্ঠিত হলো হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নাত হিসেবে মানবসন্তানকে জবেহ করার পরিবর্তে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার বিধান কোরবানি প্রথা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, তোমরা সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো।– (সুরা আল–কাওসার, আয়াত : ২)।
ইবরাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া সন্তানের আদর এবং ভালোবাসা কতো বেশি হতে পারে এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসার সামনে তা তুচ্ছ করে দেখিয়ে দিলেন তিনি। তাই আল্লাহতায়ালা তাঁর বন্ধুর এ ত্যাগকে বেশি পছন্দ করার কারণে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানব জাতির জন্যে ত্যাগের নিদর্শন স্বরূপ কোরবানি করাকে ওয়াজিব করেছেন। তাই এই কোরবানির দর্শন হচ্ছে যত পছন্দনীয় বস্তুই হোক না কেনো, তা আল্লাহর হুকুমের সামনে ত্যাগ করে আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়ন করা।
ইসলামের প্রতিটি কাজেই ত্যাগ এবং তিতিক্ষার বড়ই প্রয়োজন। কখনও নিজের প্রিয় কাজ, কখনও নিজের প্রিয় বস্তু, এমনকি সময়ে নিজের জানটাও অকাতরে বিলিয়ে দিতে হয়। আর এই ত্যাগই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কোরবানির মাধ্যমে। কোরবানি শুধু নিছক গোশত খাওয়ার নাম নয়; বরং গোশত খাওয়া আল্লাহতায়ালার একটি আদেশ মাত্র। আর কোরবানি হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাগের একটি অনুশীলন ক্ষেত্র।
কোরবানির পশু কতগুলো দৈহিক ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্চনীয়। যেমন– কানা, খোঁড়া, কান কাটা, শিং ভাঙা ইত্যাদি ত্রুটিপূর্ণ পশু কোরবানির ক্ষেত্রে বর্জনীয়। – (শামী, আলমগিরি)। সালাতুল ঈদের পর পরই কোরবানির সময় আরম্ভ হয় এবং পরবর্তী দু’দিন স্থায়ী থাকে। এ কোরবানি যিনি করেন তিনি নিজেই জবেহ করা সুন্নাত। তবে অন্য কেউ জবেহ করলেও চলবে।
এ কোরবানির গোশ্ত নিজেও খেতে পারবে এবং অন্যকেও খাওয়াতে পারবে। যাকে খুশি তাকে প্রদান করতে পারবে। তবে গোশ্ত তিনভাগ করে একভাগ পরিবারের জন্যে, একভাগ আত্নীয়–স্বজনদের জন্যে এবং অপর একভাগ দরিদ্র নিঃস্বদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া মোস্তাহাব। চামড়া দান করে দেয়া কিংবা বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ গরিব–মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে। এ কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে রাসূল (সা.)- এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘নবী (সা.) সাহাবিগণকে কোরবানির নির্দেশ দিলেন। তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন– ওহে আল্লাহর নবী! কোরবানি কী ? এতে কী রয়েছে ? তখন নবী (সা.) বললেন– কোরবানি তোমাদের পিতামহ ইবরাহিম (আ.)- এর সুন্নাত। আর এতে প্রতি লোমের বিনিময়ে একটি করে সাওয়াব রয়েছে।– (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)। নবী (সা.) আরো বলেছেন– ‘তোমরা মোটা তাজা পশু দিয়ে কোরবানি করো। কেননা, এ পশু পুলসিরাতে তোমাদের সওয়ারি হবে।’ রাসুল (সা.) আরো বলেছেন– ‘হে ফাতিমা! আপন কোরবানির কাছে যাও। কোরবানির প্রথম রক্ত বিন্দুতে তোমার আমলের পাল্লা সত্তর গুণ ভারী হবে।’ হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিন মানুষ যে সব কাজ করে তন্মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল হলো কোরবানি করা। জবেহকৃত পশু কিয়ামতের দিন তার নিজের শিং, পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানির পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা আনন্দিত মনে কোরবানি করো।– (তিরমিজি, হাকেম, ইব্ন মাজাহ্)। আর যে ব্যক্তি অলসতা ও অবহেলায় কুরবানি করে না সে কীভাবে ঈদগাহে নামাজে দাঁড়াবে? আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.)- এর সামনে কীভাবে মুখ দেখাবে? হাদিসে এসেছে– যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করলো না, সে যেনো আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।– (তিরিমিজি ও মুসতাদরাকে হাকেম)।
কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ হচ্ছে ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের পরীক্ষা। এ কোরবানির গোশত, রক্ত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং তিনি তার প্রত্যাশীও নন। তবে তিনি বিবেচনা করেন বান্দাদের তাক্ওয়া বা পরহেজগারি।– (সুরা হজ : ৩৭)। কোরবানির মধ্যে দিয়ে বান্দাদের ত্যাগ ও আত্নসমর্পণের মনোভাব কতোটা প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হলো তা তিনি দেখেন। আর এ তাক্ওয়ার চূড়ান্ত অর্থ হলো মুমিনের এই সংকল্প যে, প্রয়োজনবোধে সে এমনকি তার জীবনটিও আল্লাহর নামে সদা কোরবানি করতে প্রস্তুত। কেননা, আল্লাহ মুমিনের জান–মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।
হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহতায়ালার প্রতি আনুগত্য ও আপন পুত্রকে কোরবানির মাধ্যমে আত্নত্যাগের যে সুমহান নজির স্থাপন করে গিয়েছেন সেই স্মৃতি বিজড়িত আদর্শকে সমগ্র মুসলিম জাহান জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট দিনে পশু কোরবানি করে এ ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখে।
লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক; প্রফেসর, আরবি বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।