সম্প্রতি চীনের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে বাংলাদেশ থেকে বিলেট রপ্তানি করেছে চট্টগ্রামের একটি ইস্পাত উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। স্মরণে আসে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় বীর নুরুল কাদের খান (আমার একাত্তর গ্রন্থখ্যাত) চট্টগ্রামে ‘দেশ গার্মেন্টস স্থাপন করে চট্টগ্রাম থেকে পোশাক রপ্তানির সূচনা করেছিলেন। গত শতাব্দীর আশির দশকে মুক্তিযোদ্ধা তাহের সোবহান চিংড়ি রপ্তানি করে রাষ্ট্রীয় এওয়ার্ড পেয়েছিলেন। মৎস্য খাতের অপ্রচলিত পণ্য মাছের কানকো রপ্তানি করে সিআইপি হয়েছেন দেওয়ানজী পুকুর পাড়ের প্রতিষ্ঠান-ফ্রেন্সকো, অনুরূপভাবে মুড়ি (নামিস্তা ট্রেডার্স, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম) শাকসবজী, প্যাকেট মসল্লা মধ্যপ্রাচ্যে ও জাপানে রপ্তানি করেছে। তাহলে চট্টগ্রামকে রপ্তানির রাজধানীও বলা যেতে পারে।
ষাট দশকে আল আব্বাস নামে একটি জাহাজ কেটে চট্টগ্রামে শিপ ব্রেকিংয়ের সূচনা হয়। এখন শিপ ব্রেকিং ও রিসাইক্লিং খ্যাত চট্টগ্রামকে ‘লোহার খনি’ আখ্যায়িত করা হয়। এশিয়ার সেরা স্টিল মিলও চট্টগ্রামে ছিল। গত শতাব্দীর ৯০ দশকে চিটাগাং চেম্বার এটাকে বিএমআরই করে চালুর জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছিল। বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টরে একেএস, বিএসআরএম, কেএসআরএম, গোল্ডেন ইস্পাত সহ দেশের সেরা ইস্পাত সামগ্রী উৎপাদকরা চট্টগ্রামে অবস্থিত। প্রাপ্ত তথ্যমতে বাংলাদেশে ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন এম.এস পণ্যের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে এম. এস পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বেশ কিছু পরিমাণ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এই অব্যবহৃত পণ্য রপ্তানি করলেই সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার ও দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে। এতে দেশের ‘ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট সিকিউর’ হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। শুধুমাত্র ইস্পাত খাতে রপ্তানিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অতিমারীর সময়েও লাখখানেক মানুষের কর্মসংস্থান বেড়ে যাবে।
ইতিপূর্বে আমাদের দেশের ইস্পাত সামগ্রীর গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো না। এখন দেশে ইস্পাত সামগ্রী প্রস্তুতকৃত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিশ্বমান অর্জন করেছে। যার ফলে তারা রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ একটি কোম্পানী ১০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আদেশ পেয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর সুসংবাদ হচ্ছে, জার্মান প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এশিয়ার প্রথম ও বিশ্বে দ্বিতীয় জিপিএইচ ইস্পাত এন্টিগ্রেটেড কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রিক আর্ক ফার্নেস দিয়ে তৈরি করছে পিওর ও ক্লিন ষ্টিল। যা আন্তর্জাতিক বাজারের মান নিশ্চিত করেছে এবং এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তারা চীনে রপ্তানি করেছে ১০,১৭৫,০০০ ইউএস ডলার সমপরিমাণ কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি সমৃদ্ধ নতুন প্লান্টে উৎপাদিত ২৫,০০০ মেট্রিকটন এম. এস বিলেট। ভ্যালু ও বাল্ক হিসেবে চীনের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে তারা এঙপোর্ট বাস্কেটে নতুন মাত্রা সংযুক্ত করে বিলেট রপ্তানিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অতীতে তাদের- ২০০৮ সালে ২,৫০০ মেট্রিক টন বিলেট রপ্তানির রেকর্ড রয়েছে। ২০১০-১১ সালে ভারতে এমএস রড ও বিলেট রপ্তানির সূচনা করেছে। ভবিষ্যতে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মায়ানমারে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। এই নতুন প্লান্টে ৫০-৭০ শতাংশ আমদানিকৃত কাঁচামাল, অবশিষ্ট ৩০-৫০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৭০-১০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে।
গত ১৮ নভেম্বর ডিজিটাল প্লাটফর্মে চীনে বাংলাদেশ থেকে প্রথম বিলেট রপ্তানির শিপমেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এমপি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দূতাবাস সমূহকে সক্রিয় হতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইস্পাতের বিলেট রপ্তানির তথ্যটি পৌঁছে দেবো। উক্ত অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুল আলম চট্টগ্রাম বন্দর কৃর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এসএম আবুল কালাম আজাদ, ট্রেড ও ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুনসি শাহাবদ্দীন আহম্মেদ ভার্চুয়ালী বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে রপ্তানিকারক জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন-আমরা আশা করবো বাংলাদেশের অন্যান্য ইস্পাত উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সমূহ একই সাথে রপ্তানিতে এগিয়ে আসবে। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ কথা হচ্ছে, করোনার সময়েও রপ্তানি করা হচ্ছে এটা বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ। এতে ইস্পাত সামগ্রীর রপ্তানি পূর্বক বৈদেশিক মুদ্রা আয়, রপ্তানি বাস্কেটে নতুন আইটেম সংযুক্তি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পরিবেশ বান্ধব সবুজ কারখানা সৃজন, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন, বিশ্ববাজারে এম. এস পণ্য সমূহের ব্যাপক বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রণোদনা দেয়া অবশ্যক। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিশ্বের যেসব দেশ এম. এস পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা দিয়েছে তারা অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে ডিউটি ড্রব্যাক সুবিধাসহ এম. এস. বিলেট ও এম. এস প্রোডাক্ট রপ্তানিতে ২০% নগদ প্রণোদনা দেয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অগ্রাধিকার ভিত্তিক শিপমেন্ট, আমদানীতব্য কাঁচামাল লোডিং-আনলোডিং সুবিধা, কাস্টমস সুবিধা, এআইটিতে অগ্রিম কর না কাটা, গ্যাস বিদ্যুৎ তথা ইউটিলিটি সার্ভিসে রেয়াত চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণপূর্বক ব্যবহারের যে এজেন্ডা গ্রহণ করেছেন, তার বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড সীতাকুণ্ড-মিরসরাই এলাকায় যে প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, রপ্তানিকারকরা তার বাস্তবায়ন করেছেন। এতে ইন্ড্রাস্টিয়াল ওয়াটার প্রাপ্তি সুলভ হবে। তাহলেই সামগ্রিক ইস্পাত খাত রপ্তানিতে অনুপ্রাণিত হবে।