ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ প্রকল্পে গতির আশা

অ্যাকশন প্ল্যান তৈরিতে বিপিসির সাত সদস্যের কমিটি, রিপোর্ট আগামী মাসে এস আলম গ্রুপের সাথে যৌথভাবে নির্মাণের প্রক্রিয়া

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৪:২৭ পূর্বাহ্ণ

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট পাবলিকপ্রাইভেট পার্টনারশিপে নির্মাণের জন্য গঠিত কমিটি কাজ শুরু করেছে। বছর কয়েক ধরে চলে আসা প্রকল্পটি মাঝপথে এসে এস আলম গ্রুপের সাথে যৌথভাবে নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন সাত সদস্যের কমিটি আগামী মাসে রিপোর্ট প্রদান করার পর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন গতি আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সরকার এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন যৌথভাবে তহবিলের যোগান দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও মাঝপথে এসে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের উদ্যোগ নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের পতেঙ্গাস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল এই রিফাইনারিতে পরিশোধন করে দেশের চাহিদা মেটাতে যোগান দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে নির্মিত দেশের একমাত্র রিফাইনারিটি এখনো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হয়ে রয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগই আমদানি করা হয় পরিশোধিত অবস্থায়। ক্রুড অয়েল থেকে রিফাইনড অয়েলের মূল্য বেশ চড়া। এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেতো। কিন্তু ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় দেশে ক্রুড অয়েল আমদানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় বাড়তি অর্থ ব্যয় করে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এই বাড়তি খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে।

ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০১০ সালে দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি২ নামে নতুন একটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ২শ’ একর জায়গার একপাশের ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ঢিমেতালে চলা প্রকল্পটির ব্যয় ইতোমধ্যে ২৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকায় ঠেকেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) নানাভাবে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে সফল না হওয়ার পর সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিল। যাতে বিপিসি ৩০ শতাংশ অর্থ যোগান দেয়ার প্রস্তাব করে বাকি ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের তহবিল থেকে ঋণ হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সরকার এতে অর্থায়নের সম্মতি জানিয়েছিল। প্রকল্পের সর্বমোট ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা এবং বিপিসি ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রদান করার কথাবার্তাও চূড়ান্ত হয়। প্রকল্পের বাকি ৪৯৩ কোটি টাকার সংস্থান না হওয়ায় তা বিপিসি যোগান দেয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছিল। সরকারি তহবিল থেকে নেয়া ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকার ঋণ বিপিসি ২০ বছরের মধ্যে ৫ শতাংশ সুদসহ পরিশোধ করার কথা। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর এস আলম গ্রুপ প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়।

কিন্তু মাঝপথে এসে সম্প্রতি এস আলম গ্রুপের প্রস্তাবনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট২’ শীর্ষক প্রকল্পটি ইআরএল এবং এস আলম গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়নের অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিপিসির পরিচালক (অপারেশন) খালিদ আহম্মেদকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে বিপিসির তিনজন কর্মকর্তা, ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং দুইজন মহাব্যবস্থাপকসহ তিনজন কর্মকর্তা এবং পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করে গঠিত এই কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। কমিটিকে প্রকল্পের কারিগরি ও আর্থিক দিক, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রকল্প বাস্তবায়নের অ্যাকশন প্ল্যান, রিফাইনারি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার কৌশল এবং দায়দায়িত্বসহ হিস্যাগুলো ঠিকঠাক করার জন্য বলা হয়েছে।

এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টনের পরিবর্তে ৫০ লাখ টন শোধনের ধারণক্ষমতা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। কমিটির অন্যতম সদস্য, ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ লোকমান দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, এস আলম গ্রুপের প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ চলছে। আমরা দ্রুত এই ব্যাপারে রিপোর্ট জমা দিতে পারবো।

উল্লেখ্য, ইস্টার্ন রিফাইনারি আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে ১৭ ধরণের পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট উৎপাদন করে। এর মধ্যে বিটুমিন, এলপিজি, জেট ফুয়েলসহ নানা ধরণের পণ্য আমদানিখাতে বর্তমানে যে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে তার একটি বড় অংশই ইস্টার্ন রিফাইনারির সেকেন্ড ইউনিট রক্ষা করবে। ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরণের ভূমিকা রাখবে বলেও ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ লোকমান আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাগ্নি জামাইয়ের হাতে খুন
পরবর্তী নিবন্ধসুগন্ধা সৈকতকে বঙ্গবন্ধু বিচ নামকরণের নির্দেশনা বাতিল