ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে আলোকিত আমরা : একটি পর্যালোচনা

ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম | সোমবার , ২৭ জুন, ২০২২ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ একটি নবীন দেশ হলেও এদেশে ইসলামী শিক্ষার ইতিহাস অনেক পুরাতন। এদেশে মুসলমানদের আগমন ও ইসলামী শিক্ষার প্রচলন মূলত একই সূত্রে গাঁথা। মুসলিম শাসনামলে এই সনাতন ইসলামী শিক্ষা মাদ্‌রাসা শিক্ষা নামে এদেশে প্রধান শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত ছিল। ইংরেজ শাসনামলে শিক্ষা ব্যবস্থা দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এই দ্বৈত ধারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরেও এই দ্বৈত ধারা অটুট থাকে। সাধারণ ও মাদ্‌রাসা শিক্ষা হিসেবে আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবাহিত হয় দ্বৈত ধারায় এবং সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি হয় দ্বিধাবিভক্ত। শাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশের উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্র সাধারণ শিক্ষিতদের দিয়ে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অন্যদিকে সনাতন ইসলামী শিক্ষায় বা মাদ্‌রাসায় শিক্ষিতগণ ধর্ম প্রচার ছাড়া উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারছেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে ভিন্ন ধরনের পদচারণা। পঞ্চদশ হিজরি শতকের প্রারম্ভে বিশ্ব মুসলিম নবজাগরণের সাথে সংযুক্ত হয়ে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মাদ্‌রাসা শিক্ষার স্বীকৃতি লাভ করে।

বাংলার ইতিহাসের একটি সুদীর্ঘ সময় অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শুরু করে এবং ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত মাদ্‌রাাসা শিক্ষাই ছিল এ দেশের প্রধান শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশে ব্রিটিশ রাজস্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মুহুর্তে অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ৮০,০০০ মাদ্‌রাসা বিদ্যমান ছিল বলে জানা যায়। এ সকল প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মান ছিল খুবই উন্নত এবং প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। ঐ সময় প্রায় প্রতিটি মসজিদ ও খানকাহ মাদ্‌রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হবার প্রচলন ছিল। এ সকল শিক্ষাকেন্দ্রে এককালীন সরকারি সাহায্য অথবা জায়গীর বা ওয়াকফ সম্পত্তি প্রদান করা হতো। দেশের জনসাধারণ এ সকল প্রতিষ্ঠানে মুক্তহস্তে দান করে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করাই ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করা হতো। আমীর ওমারাহগণও এ ব্যাপারে প্রতিযোগিতামূলক বদান্যতায় অবতীর্ণ হতেন। এভাবে বহু প্রসিদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এয়োদশ শতকের প্রথম দিকে মাদ্‌রাসা হতে শিক্ষিত লোকজনের প্রাধান্য ও প্রভাব এতটাই ছিল যে, প্রায় সকল সরকারি ও বেসরকারি কার্মকাণ্ডে তাঁদের প্রাধান্য ছিল। শুধু ধর্মীয় শিক্ষক বা আধ্যাত্নিক গুরুই নয়, বরং সমাজ সেবক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সৈনিক ও নাবিক প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত সকলেই ছিলেন মাদ্‌রাসা হতে ডিগ্রি প্রাপ্ত। বস্তুত তাঁরাই ছিলেন সমাজের উচ্চ শ্রেণি এবং সমাজের প্রধান ধারা। আর সমাজের এই মূল ধারার সাথে একত্রিত সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেক অমুসলিমও মাদ্‌রাসায় অধ্যয়ন করে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে রাজনৈতিক সংস্থায় পরিণত হবার পরেই মূলত এদেশে মাদ্‌রাসা শিক্ষার অবনতি শুরু হয় এবং দেশে দ্বৈত শিক্ষা প্রবর্তিত হয়। প্রায় ২০০ বছরের রাজত্বকালে তাঁদের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এদেশের সনাতন ও স্থানীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে এবং নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। কোম্পানি ১৭৬৫ সালে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার সাথে সাথে এদেশের মুসলমান সমাজ তথা মাদ্‌রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। দেওয়ালি হস্তান্তরের সাথে সাথে সরকারের অর্থ ও রাজস্ব বিভাগ সরাসরি ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ায় কারণে এ সকল কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত কর্মকর্তার স্থানে ইংরেজ কিংবা স্থানীয় হিন্দুদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ফলে সমগ্র প্রশাসন ও রাজস্ব বিভাগে মাদ্‌রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের চাহিদা প্রায় শেষ হয়ে যায়।

১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আরও একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। যা বাংলার মুসলিম সমাজকে তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত করতে ভূমিকা পালন করে। এর ফলে সরাসরি ইসলামী শিক্ষা তথা মাদ্‌রাসা শিক্ষার ওপর মারাত্মক আঘাত হানে। কারণ সমৃদ্ধশালী মুসলিম পরিবারগুলো ইসলামী শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতায় তারা নিজস্ব খরচে স্বীয় পরিবার ও দরিদ্র শ্রেণি প্রতিবেশীর সন্তানদের ইসলামী শিক্ষা প্রদানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে তারা সম্পদ হারায় এবং ইসলামী শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক শ্রেণি নিঃশেষ হয়ে যায়। এর ফলে মাদ্‌রাসায় শিক্ষিত ও শিক্ষকতায় নিয়োজিত লোকজন বেকার হয়ে ধীরে ধীরে দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হয়। ব্রিটিশরা এদেশের ক্ষমতা গ্রহণকালে অবিভক্ত বাংলার প্রায় এক চতুর্থাংশে ভূমি বা খেরাজ ও ওয়াকফ করা ছিল। দেশের শাসক, সমাজপতি ও বিত্তশালী লোকেরা মসজিদ, মাদ্‌রাসা ও খানকাহ্‌র জন্য মৌখিকভাবেই এসব ভূমি দান করেন। কোনো প্রকার দলিল করে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। এ সকল সম্পত্তির আয় থেকে মসজিদ ও মাদ্‌রাসার ব্যয়ভার বহন করা হয়। কিন্তু এসব সম্পত্তি দলিল বিহীন বিধায় ব্রিটিশ সরকার ১৮২৮ সালে এক আইন চালু করে। এ সমস্ত সম্পত্তির স্বত্বাধিকার জব্দ করে নেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং মাদ্‌রাসায় শিক্ষিত জনগণ বেকার হয়ে পড়ে। আর যে সকল প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে তা জনগণের চাঁদার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ কারণেই ১৮২৮ সালের অর্পিত এই আইনকে অনেকেই ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা বাংলার মুসলমান ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে শেষ আঘাত হিসেবে গণ্য করা হয়।

পরবতী সময়ে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর দু’টি উদ্দেশ্য ছিল- প্রথমত, স্থানীয় জনসাধারণ, বিশেষ করে মুসলমানদের আবেদন রক্ষা করা এবং দ্বিতীয়ত, সরকারি কার্য-পরিচালনার ভাষা তখনো ফারসি থাকায় মুসলিম কর্মচারিদের ফারসি ভাষা জানা বাধ্যতামূলক। তদ্রূপ, মাদ্‌রাসা শিক্ষিতদের সরকারি কর্মকাণ্ড শেষবারের মত বন্ধ করে দেয়া হয় ১৮৩৭ সালে এবং রাষ্ট্রীয় কার্য-পরিচালনার ভাষা ইংরেজি প্রবর্তন করে। এর পরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। শুধু তাই নয়, কলকাতা মাদ্‌রাসাকে কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয়নি। অন্যদিকে এর শিক্ষা কার্যক্রমও মুসলিম জনগণের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে খারিজী মাদ্‌রাসা বা কওমী মাদ্‌রাসা নামে এক ধরনের মাদ্‌রাসার উন্মেষ ঘটে।

১৮৫৪ সালে শিক্ষা সংক্রান্ত ডেম্পাচ এ কলকাতা মাদ্‌রাসাকে প্রস্তাবিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার ইঙ্গিত থাকলেও মাদ্‌রাসাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়নি। ১৮৬৩ সালে কলকাতা মাদ্‌রাসায় এফ. এ. পর্যায়ের ক্লাস সংযোজিত করা হয়। ১৮৬৯ সালে স্থগিত রাখা হয় এবং ১৮৮৮ সালে তা বাতিল করা হয়। ১৮৬৪ সালে মাদ্‌রাসায় একটি পৃথক ইনস্টিটিউট হিসেবে ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদেরকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা। ১৮৬৩ সালে নবাব আব্দুল গণির জামাতা খাজা মুহাম্মদ আজগর ও মৌলবী ইলাহাবাদ খান ঢাকাতে মোহামেডান লিটেরারি সোসাইটির একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামী শিক্ষার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তাদের সন্তানদের বিদ্যমান সরকারি বা প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাঠাতে অনিচ্ছুক ছিল। কেননা এ সকল প্রতিষ্ঠানে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। দেশে যদি পৃথক কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয় আর সেখানে যদি আরবি ও ফারসির সাথে ইংরেজিও শিক্ষা দেয়া হয়। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠাতে ইচ্ছুক।

নবাব আব্দুল গণির নেতুত্বে ঢাকায় প্রভাবশালী মুসলমানরা ১৮৭২ সালে সরকারের কাছে একটি মাদ্‌রাসা স্থাপনের জন্য আবেদন করেন। এর পেছনে কিন্তু কিছুটা আঞ্চলিকতা কাজ করেছিল। কেননা এ সময়েই বাংলা সরকার চট্রগ্রামে একটি মাদ্‌রাসা স্থাপনের পরিকল্পনা করে। চট্রগ্রামকে নির্ধারণ করার পেছনে যে কারণ ছিল। তা হলো সেখানে আরবি ও ফারসি শিক্ষার চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি। এ নীতি নির্ধারণের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরপরই ঢাকা থেকে ঐ আবেদনপত্রটি সরকারের কাছে প্রেরণ করা হয়। আর আবেদনপত্রে অবশ্য চট্রগ্রামের চেয়ে ঢাকার দাবিটিই ছিল বেশ জোরালো। তাই সরকারও এ দাবির পক্ষে যুক্তিগুলি মেনে নেয়। এর ফলে ১৮৭৩ সালের জুলাই মাসে বাংলা সরকার মহসিন ফান্ড থেকে বার্ষিক ১০ হাজার আলাদা করে ঢাকায় একটি নতুন সরকারি মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। সরকারি কর্মকর্তা এবং নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তিবর্গ নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। মূলত কমিটিই নতুন মাদ্‌রাসাটির তত্ত্বাবধান করে। ঢাকা ইতিহাস ও নগর জীবন ১৮৪০-১৯২১ এর লেখক শরীফ উদ্দিন আহমেদ লিখেন, ১৮৭৪ সালের ১ মার্চে বিশিষ্ট পণ্ডিত ভাষাবিদ বাহারুল উলম মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় সরকারি মাদ্‌রাসা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৮৮৫ সালের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে কলকাতার পরই ঢাকা বাংলার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।

লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের কালের একজন গণনায়ক
পরবর্তী নিবন্ধসফল হলো প্রধানমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ