মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে ৫৭ মুসলিম রাষ্ট্র। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর পৃথিবীর একমাত্র ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের ভেতর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস অপারেশন আল্–আকসা পরিচালনার মাধ্যমে ১২০০ ইসরায়েলিকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেওয়ার পর বর্বর ইসরায়েলের কসাই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনের সাধারণ নিরীহ গাজাবাসীদের উপর যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে তা আজ এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬০ হাজারের অধিক ছাড়িয়েছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ মানুষকে শহীদ করেছে বর্বর ইহুদিরা–যাদের সবাই নিরপরাধ।
অন্য এক সূত্রে এই সংখ্যা আরও অধিক হতে পারে। গাজা এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে, যেন কিছুদিনের মধ্যে গাজা নামক সিটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। বর্বর ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতি লঙ্ঘন করে একদিনে ৪০০ মানুষকে মর্মান্তিকভাবে শহীদ করেছে–যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। গাজাবাসী এখন এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বাস করছে– নেই এক মুঠো খাবার, সুপেয় পানি, আবাসন ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এতটুকু মাথা গোজার ঠাঁই। পৃথিবীর জঘন্যতম মানবেতর জীবনযাপন যেন গাজাবাসীর। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য মানুষেরা দু’বেলা খেতে পারছে, শান্তিতে ঘুমাতে পারছে সেখানে গাজার আবাল–বৃদ্ধ–বণিতাকে পাখির মতন গুলি করে হত্যা করছে বর্বর ইসরায়েলি সেনারা। আর এদিকে ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। মিডিয়াগুলোতে বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই যেন তাদের নিন্দা সীমাবদ্ধ। সামরিক শক্তিমত্তায় পরিপূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করছে না। আর এই বর্বর, মধ্যপ্রাচ্যের কসাই খ্যাত নেতানিয়াহুকে আসকারা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আমেরিকান ক্ষ্যাপাটে ও মানসিক বিকারগ্রস্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার আসকারা পেয়েই নেতানিয়াহু বর্বর গণহত্যা চালাচ্ছে গাজায়। হামাস নিধনের নামে পুরো গাজা শহরকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার কুমতলবের পথে হাঁটছে নেতানিয়াহু প্রশাসন। গাজার ৮০ শতাংশ ভবন সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এখন বলা হচ্ছে–গাজা পৃথিবীর বৃহত্তম শবাধার।
এদিকে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে ইসরায়েলের বিমান বাহিনীর ১ হাজার সেনা গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার আহবান জানিয়ে একটি চিঠিতে সই করেছে। এই চিঠিটি প্রকাশ করেছে দেশটি সংবাদ মাধ্যম হারেৎজ। এই সমস্ত রিজার্ভ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে সরকার। চিঠিতে বলা হয়েছে–বর্তমানে ইসরায়েলের এই যুদ্ধ মূলত রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা করছে, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে নয়। আর এই গণহত্যার বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে গর্জে উঠেছে মুসলিম জনগোষ্ঠি, এমনকি শান্তিকামী অমুসলিম জনগোষ্ঠীও বিক্ষোভে নেমেছে। সারা রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল জনপদ কিন্তু এই বিক্ষোভ, কর্মসূচী ইসরায়েলের কর্ণকুহুরে কোনদিন প্রবেশ করবে না। খোদ ইসরায়েলের ভেতর নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে সেই দেশের জনগণ। গাজার শরণার্থী শিবিরগুলো যেন ইসরায়েলি সেনাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। গাজার নিরীহ বাসিন্দারা প্রতি মূহুর্তে মৃত্যুর প্রহর গুণছে–এই যেন তাদের উপর বোমা পড়ছে। বোমার আঘাতে আযানরত অবস্থায় মুয়াজ্জিনও শহীদ হতে দেখা যায় এক ভিডিওতে। বোমার আঘাতে লন্ডভন্ড শরীরের বিভিন্ন অংশ আকাশে উড়তে দেখা যায়। কি এক বীভৎস পৃথিবী দেখছে! ইসরায়েলের এই বর্বরতা দেখেও শক্তিধর মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নির্বিকার । তারা কেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তা সহজেই অনুমেয়।
জাতিসংঘ শুধুমাত্র বক্তৃতা, বিবৃতির মাধ্যমে তাদের নিন্দা অব্যাহত রেখেছে। গাজা উপত্যকার এই নিরীহ মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে আসছে বর্বর ইসরায়েল কর্তৃক। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানরা তাদের গদি রক্ষায় গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না–এটা দিবালোকের মতন স্পষ্ট। সীমিত শক্তি নিয়ে এখনও ইহুদীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস এবং অপরাপর অক্ষশক্তি–যেমন: ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা শুরু থেকেই নিরীহ ফিলিস্তিনি মানুষদের সমর্থনে তেল আবিবে একের পর এক মিসাইল ছুড়ছে। আর লোহিত সাগরে চলাচলকারী ইসরায়েল ও আমেরিকার জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে। মার্কিন রণতরি হ্যারিম্যান–টু কে বারবার আঘাতের পর আঘাত করে হুতিরা সামরিক শক্তির জানান দিয়ে যাচ্ছে ঘুমন্ত বিশ্ব বিবেককে। জবাবে মার্কিন বাহিনী নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে ইয়েমেনের বিভিন্ন শহরে মানুষ হত্যা করছে। এরপরেও হুতিরা গাজাবাসীর সমর্থনে তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছে।
লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীও গাজার নিরীহ মানুষদের সমর্থনে বর্বর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিলো। এতে গাজাবাসীর সমর্থনে তাদের সামরিক সহযোগিতা স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিধর মুসলিম রাষ্ট্র ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার। ইরানি মদদপুষ্ট অক্ষশক্তিসমূহ শুরু থেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে আসছে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ১০ টি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। আর এক শক্তিধর ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র ফ্রান্সও স্বীকৃতি দেওয়ার পথে। জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে ১৪৭টি ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেন। গাজার শিশুদের মানবেতর জীবন আর তাদের গণহত্যার দৃশ্য দেখে পাষাণ হৃদয়ের মানুষও স্থির থাকতে পারে না। কংক্রিটের নীচ থেকে গুরুতর আহত বাচ্চাকে কুকুর উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বে যেন ভাইরাল। বোঝা যায়–কুকুরেরও মানবতা আছে, নেই বিশ্ব মুসলিম দেশের আরব শেখদের। বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত এ সব শেখদের চোখে এই করুণ দৃশ্য চোখে পড়ে না। আর এদিকে ক্ষ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজাকে বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার ফন্দি–ফিকির আঁটছে। গাজায় যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি হলেও গাজা ও মিশরের মধ্যে অবস্থিত বাফার জোন নামক নিরাপত্তা অঞ্চল দখল করে গাজাকে বিভক্ত করার ফন্দি আঁটছে ধূর্ত নেতানিয়াহু।
মহান আল্লাহতায়ালা ১৪০০ বছর আগে এই সমস্ত বর্বর ইহুদি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তাঁর পবিত্র কালামে বলেন, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ইহুদি খ্রিস্টানদের নিজেদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ কর না। এরা নিজেরা একে অপরের বন্ধু: তোমাদের মধ্যে কেউ যদি এদের কাউকে বন্ধু বানিয়ে নেয় তাহলে সে অবশ্যই তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবে আর আল্লাহতায়ালা কখনো জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দান করেন না’ – সূরা মায়েদা– ৫১। নিরীহ গাজাবাসীদের কান্নায় আল্লাহর আরশ যেন কেঁপে উঠছে। তারা ফরিয়াদ করে বলছে, ‘তোমাদের এ কি হয়েছে? তোমরা আল্লাহর প্রতি সে সব অসহায় নর নারী ও শিশু সন্তানদের জন্য লড়াই কর না। যারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব–জালেমদের এই জনপদ থেকে তুমি আমাদের বের করে নাও, অতঃপর তুমি আমাদের জন্যে তোমার কাছ থেকে একজন অভিভাবক বানিয়ে দাও, তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্যে একজন সাহায্যকারী বানিয়ে দাও’– সূরা আন নিসা – ৭৫।
এই ফিলিস্তিনে রয়েছে মুসলিমদের প্রথম কেবলা মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস। আল্লাহর নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) মেরাজে যাওয়ার সময় এই মসজিদে সোয়া লক্ষ পয়গম্বরদেরকে সাথে নিয়ে তাঁর ইমামতিতে নামাজ আদায় করেছিলেন। এই বরকতময় মসজিদে এক রাকাত নামাজ পড়লে ১০০০ রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়। এই মসজিদে মাঝে মাঝে বর্বরতা চালায় কসাই ইহুদি সৈন্যরা। এই ফিলিস্তিনের সাথে সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননের কিছু অংশ নিয়ে শাম দেশ গঠিত। বায়তুল মোকাদ্দাস বা আশপাশের এলাকা নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অনেক ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত–আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত সংগঠিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিমদের সাথে ইহুদিদের যুদ্ধ হবে। মুসলিমরা ইহুদিদেরকে হত্যা করবে, ইহুদিরা পাথর বা বৃক্ষের পেছনে লুকিয়ে থাকবে–তখন বৃক্ষ ও পাথর বলবে, হে আল্লাহর বান্দা! আমার পেছনে ইহুদি লুকিয়ে রয়েছে তাকে হত্যা কর। কিন্তু গারকাদ গাছ তা বলবে না কারণ এটা ইহুদিদের গাছ’। ফিলিস্তিনকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পবিত্র ভূমি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।
এখন যে অবস্থা চলছে ইমাম মাহদী আসার যেন পূর্ব সংকেত বিশ্ববাসী দেখতে পাচ্ছে। আমরা সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব যখন ইমাম মাহদীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুসলিমরা জেহাদ করবে এবং সেই যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করবে।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল