প্রবাহ

| বুধবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

ইরানের গিলানে পীরানে পীরের আম্মাজানের যেয়ারত

১১ রবিউস সানি তথা ১৫ অক্টোবর মঙ্গলবার ছিল কাদেরিয়া তরিকার ইমাম পীরানে পীর বড় পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী। সেউপলক্ষ্যে আজকের এই প্রয়াস।

প্রাচীন পারস্য আজকের ইরান। ইরানের একটি প্রদেশের নাম গিলান। পীরানে পীর বড় পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র জন্মভূমি এই গিলান। হযরত বড় পীরের আব্বা আম্মা এই গিলানে শায়িত। হযরত বড় পীর (রহ.) উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য জ্ঞান বিজ্ঞানের নগরী বাগদাদে গমন করেন। সেখানে জীবন কাটান। এই বাগদাদ নগরীতেই তিনি শায়িত। ১৯৯৭ সালে হজ্বের পর সপ্তাহ খানেকের জন্য ইরাক সফর করার সুযোগ হয়। অবস্থান করা হয়েছিল রাজধানী বাগদাদ নগরীতে হযরত বড় পীর (রহ.)’র মাজারের একদম নিকটে। ফলে নিয়মিত যেয়ারত করার সুযোগ হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে প্রথম বার ইরান গমন করা হয়। থাকা হয় এক নাগাড়ে ১২ দিন। এই সফরে একদিন এক রাতের জন্য গিলানে প্রোগ্রাম রাখা হয়। ইরান সফরে সাথী ছিলেন নরসিংদীর বাসিন্দা ঢাকা মতিঝিলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসাইন (বর্তমানে মরহুম)

গিলান প্রদেশ পাহাড়পর্বত এরিয়া নিয়ে কাস্পিয়াম সাগরের তীরে। যা তেহরান থেকে বিশ্বখ্যাত আল বুরুজ পর্বত পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। গিলান প্রদেশের রাজধানীর নাম রাষ্ট্র।

সহযাত্রী সাখাওয়াত হোসাইন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, ইরান ও তুরস্কে পাট রপ্তানীকারক। ইরানে বাংলাদেশের পাট দিয়ে কার্পেটসহ নানান কিছু তৈরি করা হয়। সেই লক্ষে ইরানের বিভিন্ন শহরে রয়েছে অসংখ্য মিল ফ্যাক্টরী। ইরানের মিল ফ্যাক্টরীর মালিকগণ সাখাওয়াত সাহেবকে আতিথেয়তা সহ সফরে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। তেমনিভাবে গিলানের রাজধানীতেও রয়েছেন তাঁর ব্যবসায়িক বন্ধু ইরানী হাসান পারভানে।

সাখাওয়াত সাহেবকে জানিয়ে রাখি ইরান সফরে তেহরানের পাশাপাশি আমি কয়েকটি শহরে যেতে অত্যধিক আগ্রহী। তৎমধ্যে হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর শহর বাস্তাম। শাহ আব্বাসের শহর ইস্পাহান। হযরত শেখ সাদীর শহর সিরাজ, ইরানের ধর্মীয় শহর কোম, পীরানে পীর বড় পীরের জন্মভূমি গিলান, ইবনে সিনার শহর হামেদান। সাথে সম্ভব হলে সহীহ হাদীস সংকলক ইমাম মুসলিম ও হযরত ফরিদউদ্দিন আত্তারসহ ইমাম অলিগণের শহর নিশাপুর, ইমাম অলি দরবেশের শহর তূস। পারস্যে তথা আজকের ইরানে হাজার হাজার বিশ্বখ্যাত ইমাম, সুফি, কবি, দরবেশ শায়িত। সাখাওয়াত সাহেব আগে ২ বার ইরান যেয়ে থাকলেও অনেকটা রাজধানী তেহরান কেন্দ্রীক। তৃতীয়বার আমাকে পেয়ে তিনি অত্যধিক খুশি। আমার ইরান সফরের জন্য সাখাওয়াত সাহেবের মত একজন সফর সাথী দরকার। আমাদের এক নাগাড়ে ১২ দিনের প্রোগ্রাম রাখা হয়। তৎমধ্যে একদিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর যেয়ারতে, আরেক দিন হামেদানে ইবনে সিনার যেয়ারতে। হোটেলের মাধ্যমে টেক্সি ঠিক করে আমি একা সারাদিনের জন্য বের হয়েছিলাম যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। তেহরান থেকে বাস্তাম ৪৫০ কি.মি পূর্ব দিকে হামেদান ৩৭০ কি.মি পশ্চিম দিকে।

আমাদের হোটেল ছিল তেহরান মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে। আমরা হোটেলের নিকটে একটি ট্রাভেল এজেন্সী থেকে টিকেট কাটি ৩ রাত ৪ দিন ইস্পাহান ও সিরাজে সফরের উদ্দেশ্যে এবং তেহরান ফিরে ২ রাত পর গিলানের রাজধানী রাস্টের টিকেট কাটি অতি ভোরের ফ্লাইটে। তৎ পরের দিন ভোরের ফ্লাইটে ফিরে আসা। আমাদের টিকেটগুলো ছিল ইরানের জাতীয় এয়ারলাইন তথা ইরান এয়ারে। বিশ্বের যে কোন দেশে জাতীয় এয়ার লাইনে আতিথেয়তা তথা মান সম্পন্ন খাবার দেয়। বিশ্বে অনেক দেশের জাতীয় এয়ার লাইনের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। শুধু ব্যতিক্রম পেয়েছিলাম মিশরের জাতীয় এয়ারলাইন ইজিপ্ট এয়ারে। তিনবার তাদের আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে এক বোতল পানি বাদে আর কিছু দেয়নি। সাখাওয়াত সাহেব গিলানের রাজধানী রাস্টে ব্যবসায়িক বন্ধু হাসান পারভানেকে জানিয়ে রাখেন। তারও খুব আগ্রহ আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করতে। সাখাওয়াত সাহেব তার ব্যবসায়িক বন্ধুকে আরও জানিয়ে রাখেন আমাদের অতি আগ্রহ হযরত বড় পীরের আব্বাজান আম্মাজানের যেয়ারতে গমনের, সে লক্ষে তিনি খবরাখবর যাতে নিয়ে রাখেন।

আমাদের ফ্লাইটটি ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর (২০০৭ সাল) সোমবার। আমরা সুব্‌হে সাদেক হওয়ার সাথে সাথে ফজরের নামাজ পড়ে বিমান বন্দরে রওনা করি। আগেই অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করা আছে তেহরান থেকে ২০/২৫ কি.মি দূরে ইমাম খোমেনী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর চালু হওয়ার পরও শহরের মধ্যখানে আগেকার মেহেরাবাদ বিমান বন্দরটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এবং সীমিত সংখ্যক আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য চালু রয়েছে। আমরা মেহেরাবাদ বিমান বন্দরে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করি। তুরস্কের মত ইরানীরা শিক্ষিত জাতি। তাদের জীবনযাত্রা সুন্দর পরিচ্ছন্ন। যেমনটা বিমান বন্দরে বিমানে সবকিছুতে। এটা স্বল্প দূরত্বের ফ্লাইট, যদিওবা বিশ্বখ্যাত আলবুরুজ পর্বত পার হয়ে যাবে। ইরান এয়ারে তেহরান থেকে ইস্পাহান, ইস্পাহান থেকে সিরাজ, সিরাজ থেকে তেহরান আসতে এই তিন সেক্টরে একটি খাবার প্যাকেট দিয়েছিল। এই প্যাকেটি পূর্ণাঙ্গ ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের জন্য বলতে যথাযথ। রয়েছে ৪/৫ আইটেম সুস্বাদু স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। মেহেরাবাদ বিমান থেকে আকাশে উড়ার সাথে সাথে বিমানবালারা যাত্রীদের খাবারের প্যাকেট দিয়ে দেয়। প্যাকেট খুলে খাবার চলাকালীন বিমান প্রচন্ড ঝাঁকুনি দেয়। যা পরদিন রাস্ট থেকে আসবার সময়ও। মনে হল আলবুরুজ পর্বত পার হতে আবহাওয়া বাতাসের তারতম্যে হয়তোবা। ছোটখাট বিমান বন্দর, ফ্লাইটের সংখ্যাও সীমিত। হাসান পারভানে আমাদেরকে বিমান বন্দরে স্বাগত জানিয়ে তার অফিসে নিয়ে যায়। ওখান থেকে আমাদেরকে একটি স্টারমানের হোটেলে নিয়ে যায় সকালের ব্রেকফাস্ট করানোর জন্য। ইরান এয়ারের খাবারের প্যাকেটটি সকালের ব্রেকফাস্টের জন্য যথেষ্ট। তারপরও তাকে খুশি করতে বুফে সিস্টেমে কিছু কিছু আইটেম নেয়া হয়। আমি কিন্তু ছটফট করতেছি যেয়ারতের উদ্দেশ্যে যেহেতু কালকে ভোরে আমাদের তেহরান গমনের ফ্লাইট। হোটেল থেকে বের হয়ে সূমে সারার দিকে যেতে থাকি হযরত বড় পীরের আম্মাজান হযরত উম্মুল খায়ের (রহ.)’র যেয়ারতের উদ্দেশে। সূমে সারার অবস্থান রাজধানী রাস্ট থেকে হয়ত ১৫/২০ কি.মি হবে, যা অনেকটা সমতল ভূমিতে। সূমে সারা একটি ছোট উপশহর। এখানে হযরত বড় পীরের আম্মাজানের কবরের অবস্থান বের করতে কষ্ট হচ্ছিল স্থানীয়দের জানা না থাকার কারণে। শেষ পর্যন্ত আমরা অভিষ্ট মাজারে পৌঁছলাম। একটি মাত্র কবর চতুর্দিকে কার্পেট বিছানো খালি জায়গা। একজন অতি বয়স্ক মহিলা দেখলাম দায়িত্বরত। এখানে আমরা যেয়ারতে সময় দিলাম। চৌচালা একটি স্থাপনা অনেকটা ৩০ ফুট বাই ৩০ ফুট ব্যাসের মাজার। কবর আর দেওয়ালের মধ্যখানে যেয়ারত করার জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে।

হাসান পারভানে সূমে সারা আসার সময় গাড়িতে বলতেছিলেন হযরত বড় পীরের আব্বাজান (হযরত সৈয়দ শেখ আবু ছালেহ জঙ্গি রহ.)’র মাজার এখান থেকে ৮০/৯০ কি.মি দূরে দুর্গম পাহাড়ের ভিতর। জায়গাটির নাম ফূলাম। কিভাবে এ দিকে যাওয়া যাবে তাও অজানা। হাসান পারভানে ফূলাম যাওয়া অসম্ভব বলে মনে করে আমাদের নিকট হতাশা ব্যক্ত করলেন। হযরত সৈয়দা উম্মুল খায়ের (রহ.)’র মাজারের খাদেমা থেকে জানতে চাইলে তিনিও তা অনেক দূরে গভীর অরণ্যে বলেন। হযরত বড় পীর (রহ.)’র আব্বাজান ও আম্মাজানের দাম্পত্য জীবন নিয়ে চমকপ্রদ ঘটনা রয়েছে। যা এখানে সীমিত পরিসরে ব্যক্ত করা হল না। ইরানে শায়িত রয়েছেন অনেক ইমামজাদা তথা আওলাদে রাসূল। ওমাইয়া আব্বাসীয়দের দমন নিপীড়নে অনেক আওলাদে রাসূল হেজাজ তথা পবিত্র আরব ভূমি থেকে পারস্য হিযরত করেছিলেন। ইরান বলতে শিয়া অধ্যুষিত, তারা ইমামজাদাইমামজাদির প্রতি অত্যধিক আশেক। তাদের মাজারে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে কার্পণ্য করেন না।

ইরানে রয়েছে অসংখ্য তথা শত শত ইমামজাদাইমামজাদির মাজার। আলবুরুজ পর্বতের গিলান প্রদেশের দিকে গভীর অরণ্যে রয়েছে ইমামজাদা ইব্রাহীমের মাজার। হাসান পারভানের আগ্রহ যেহেতু সময় আছে আমাদেরকে ইমামজাদা ইব্রাহীমের মাজারে নিয়ে যেতে। তাদের বর্ণনা মতে বৃহত্তর বাগদাদে শায়িত ইমাম মুসা কাজেমের পুত্র তিনি। বেলা ১১ টার দিকে হযরত সৈয়দা উম্মুল খায়ের (রহ.)’র যেয়ারতের পর ইমামজাদা ইব্রাহীমের যেয়ারতের দিকে যেতে থাকি। পাহাড়পর্বতের ভিতর আঁকাবাঁকা গাড়ি উপরের দিকে উঠতেই আছে। প্রায় ২০২৫ কি.মি যাওয়ার পর মাজার কমপ্লেক্স পৌঁছি। মাজার কমপ্লেক্সে রয়েছে হোটেল রেস্টুরেন্ট। এখানে যোহরের নামাজ ও দুপুরের খাবার খাওয়া হয়। বিকেলের দিকে রাস্টে ফিরে আসি। পারভানে সাহেব আমাদের সম্মানার্থে স্বাচ্ছন্দে কাস্পিয়াম সাগরের তীরে স্টারমানের হোটেলে কক্ষ বুক করে রাখেন। আমরা এ হোটেলে রাত্রিযাপন করি। পরদিন ভোরে তিনি নিজে এসে আমাদেরকে বিমান বন্দরে পৌঁছে দেন। সমগ্র ইরানে গাড়ির আয়না বন্ধ রাখতে হচ্ছিল শুষ্ক আবহাওয়া বাতাস অসহনীয় বলে। আলবুরুজ পর্বতের উত্তরপাশে গিলান প্রদেশ সবুজে সমারোহ। বাতাস আরামদায়ক গাড়ির জানালা খোলা রাখা হয়। এখানে যেদিকে যাওয়া হয় সেদিকে সবুজ আর সবুজ। কাস্পিয়াম সাগর, সাগর বলা হলেও এটা বিশ্বের বৃহত্তম হ্রদ। এই হ্রদের তীরে রয়েছে বিভিন্ন দেশের বন্দর। সে লক্ষ্যে রয়েছে জাহাজ চলাচল। এই হ্রদের আয়তন ৩ লাখ ৭১ হাজার বর্গ মিটার। যা বাংলাদেশ থেকে তিনগুণ বড়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিহাবের রেজাল্ট পেয়ে দোয়া চাইলেন স্বজন-সহপাঠীরা
পরবর্তী নিবন্ধজিপিএ ৪.৮৩ পাওয়া শাহরিয়ার দেখে যেতে পারলেন না তার ফলাফল