ইরানে হানা দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন ট্রাম্প?

| বুধবার , ২৫ জুন, ২০২৫ at ৬:৫৫ পূর্বাহ্ণ

অভিযোগ উঠেছিল গত রোববারেই। একতরফাভাবে ইরানের পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলার নির্দেশ দিয়ে ট্রাম্প আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন ডেমোক্র্যাটদের অনেকে। এরপর একই অভিযোগ ওঠে ট্রাম্পের নিজ দল রিপাবলিকান পার্টি থেকেও। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বৈধতা নিয়ে দেশের আইনসভা কংগ্রেসের ভেতরেও দুই দলেরই কয়েকজন আইনপ্রণেতা প্রশ্ন তুলেছেন। খবর বিডিনিউজের।

রিপাবলিকানদের অনেকে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও অন্তত দুইজন রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, কংগ্রেসের অনুমোদন না নিয়ে ট্রাম্প যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান পরিপন্থি। রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য থমাস ম্যাসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সএ লিখেন, এই হামলা সাংবিধানিক নয়। ম্যাসির দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, আক্রমণের মুখে না পড়ার পরও অন্য দেশের ভূখণ্ডে হামলা চালাতে গেলে কংগ্রেসের অনুমোদন অপরিহার্য। কিন্তু ট্রাম্প তা করেননি। রিপাবলিকান পার্টির প্রভাবশালী কংগ্রেস সদস্য ওয়ারেন ডেভিডসন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, এটি (ইরানে হামলা) সাংবিধানিক ভাবে বৈধ, এমন যুক্তি কল্পনা করাও কঠিন।

এই সমালোচনা এবং প্রশ্নের মুখে রিপাবলিকান নেতা ও প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন দাঁড়িয়েছেন ট্রাম্পের পাশে। তার ভাষ্য, তিনি (ট্রাম্প) মনে করেছিলেন, আসন্ন ঝুঁকি এতটাই বড় যে, কংগ্রেসের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করার সময় ছিল না। আর যুক্তরাষ্ট্রের আগের অনেক প্রেসিডেন্টও একইভাবে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

সামরিক অভিযান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান কী বলছে : সামরিক অভিযান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দুইটি অংশ আছে আর্টিকেল১ এবং আর্টিকেল২। আর্টিকেল১ অনুযায়ী, যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা আছে কেবলমাত্র কংগ্রেসের। ওদিকে, আর্টিকেল২ অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। সেকারণে তিনি বিশেষ পরিস্থতিতে প্রয়াজন অনুযায়ী সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করতে পারেন। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পক্ষে সংবিধানের এই আর্টিকেল ২ এর যুক্তি দিয়ে হোয়াইট হাউজ ও ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট এর ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এই নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ঠিক কী সে সম্পর্কে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা এইসব পরিস্থিতির ব্যাখ্যায় বলছেন, যদি প্রকৃতই বা সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা থাকে, কিংবা জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের বিষয়টিও আসতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার ঠেকানোই ইরানে হামলার মূল কারণ ছিল বলে যুক্তি দিয়েছে।

চারজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে হামলার নির্দেশ দেওয়ার কিছুটা আইনি অধিকার ছিল ট্রাম্পের। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেইনিয়ার অধ্যাপক ক্লেয়ার ফিনকেলস্টাইন বলেন, সংক্ষেপে বললে, হ্যাঁ, এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের সে ক্ষমতা ছিল। অতীতেও বহু প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া একতরফাভাবে সামরিক অভিযান চালিয়েছেন। আরেকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ জেসিকা লেভিনসন মনে করেন, প্রেসিডেন্টের সীমিত পরিসরে বিমান হামলার অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা আছে, যতক্ষণ না তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়। কিন্তু সেরকমটি কখন ঘটবে তার কোনও সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই।

তবে বোডুইন কলেজের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু রুডালেভিজ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, দেশ যেহেতু কোনও আক্রমণ প্রতিহত করার মতো পরিস্থিতিতে পড়েনি, সেকারণে আরেক দেশে হামলার নির্দেশ দেওয়ার আইনি এখতিয়ার ট্রাম্পের ছিল না।

সংবিধানে কংগ্রেসকে যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হলেও বাস্তবে এর ব্যবহার হয়েছে খুব কমই। শেষবার কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন জাপান পার্ল হারবারে হামলা করেছিল। এর আগে ১৮১২ সাল থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে কেবল ১০ বার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামপ্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্টদের কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া সামরিক অভিযান চালানো অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্য কী কী আইন রয়েছে : ইরানে ট্রাম্পের হামলার সমালোচকরা একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের কথাও তুলে ধরেছেন। সেটি হল ‘ওয়ার পাওয়ার্স রেজোলিউশন’। ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র্রের পিছু হটে আসার পর এ আইন পাস হয়েছিল। কংগ্রেসের পরামর্শ ছাড়া প্রেসিডেন্ট যেন সহজে যুদ্ধ শুরু না করতে পারেন সেজন্যই করা হয়েছিল এই আইন। এ আইন অনুযায়ী, জরুরি পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের সামরিক শক্তি ব্যবহারের এখতিয়ার থাকলেও এতে বলা আছে, যুদ্ধ বা সংঘর্ষে জড়ানোর আগে প্রতিটি পদক্ষেপেই প্রেসিডেন্টকে যতটা সম্ভব কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। ‘ওয়ার পাওয়ার্স রেজোলিউশন’ আইনে আরও বলা আছেসামরিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কংগ্রেসকে তা জানাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, ইরানে হামলা চালিয়ে বিমানগুলো নিরাপদে ফিরে আসার পরই কংগ্রেসকে জানানো হয়েছে এবং ওয়ার পাওয়ার্স আইনের নিয়ম মেনে চলা হয়েছে।

আগের প্রেসিডেন্টরা কী করেছিলেন : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কংগ্রেসের অনুমতি না নিয়ে লিবিয়ায় হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সংবিধানের আর্টিকেল২ এর আওতায় এর বৈধতা আছে বলে জানিয়েছিল তার প্রশাসন। একই সাংবিধানিক ধারার ভিত্তিতে ওবামা ২০১১ সালে পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা অভিযান চালানোরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তার প্রথম মেয়াদে কংগ্রেসকে না জানিয়ে ইরানের সামরিক কর্মকর্তা কাসেম সোলেমানিকে হত্যার নির্দেশ দেন। এর আগে ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯০এর দশকে বলকান অঞ্চলে কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া হামলা চালিয়েছিলেন। একইভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সিরিয়ায় এবং ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালান কংগ্রেসের অনুমতি না নিয়ে।

প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা তার আমলে লিবিয়ায় সরকার পতন ঘটাতে আট মাস বিমান হামলা চালিয়েছিলেন। তখন আমি কখনও কোনও ডেমোক্র্যাটকে আপত্তি করতে শুনিনি। আর এখন হঠাৎই সবাই আপত্তি শুরু করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাবেক কাউন্সিলর সুমন ও তার স্ত্রীর সাড়ে ১১ কোটি টাকার সম্পদ জব্দের নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধএইচএসসি পরীক্ষা কাল থেকে