ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ান গত রোববারের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাদের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ইরানের মন্ত্রিসভা এক বিবৃতিতে বলেছে, ইরানি জাতির জন্য নিজের ‘জীবন উৎসর্গ’ করেছেন ইব্রাহিম রাইসি। তার দেখানো পথেই ইরান থাকবে। রাইসির মৃত্যুতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রাষ্ট্রীয় টিভি ঘোষণা করে, ইরানি জাতির সেবক, আয়াতুল্লাহ ইব্রাহিম রাইসি, শাহাদাতের সর্বোচ্চ স্তর অর্জন করেছেন। এ সময় কোরআন তেলাওয়াতের সঙ্গে রাইসির ছবি সম্প্রচার করা হয়। পাশাপাশি তেহরানের দক্ষিণে কোম শহরে একটি প্রধান শিয়া মাজারে শোকের চিহ্ন হিসেবে একটি কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
বিডিনিউজ জানায়, রোববার আজারবাইজান সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাস নদীর ওপর একটি বাঁধ প্রকল্প উদ্বোধনের পর উত্তর–পূর্বাঞ্চলের শহর তাবরিজে ফিরছিলেন রাইসি এবং তার সফরসঙ্গীরা। ঘন কুয়াশার মধ্যে হেলিকপ্টারটি পার্বত্যাঞ্চলে দুর্ঘটনায় পড়ে। এরপর ৪০ জনের বেশি উদ্ধারকর্মী, অনুসন্ধানী কুকুর এবং ড্রোন দিয়ে শুরু হয় বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুয়াশার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে উদ্ধারকর্মীদের বেগ পেতে হয়। পরে গতকাল সোমবার সকালে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেওয়া একটি তুর্কি ড্রোন ‘হিট সোর্স’ শনাক্ত করলে দুর্ঘটনাস্থলের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু পাহাড়ের উপরে হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার পর ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান হোসেইন কোলিভান্দ বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে প্রাণের কোনো চিহ্ন মেলেনি। রয়টার্স লিখেছে, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি পুড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ড্রোন থেকে তোলা বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে।
দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দোল্লাহিয়ানসহ ওই হেলিকপ্টারে থাকা কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও মারা গেছেন।
৬৩ বছর বয়স্ক রাইসি দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ২০২১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। রোববার দুর্ঘটনার পর তাকে জীবিত উদ্ধারের আশা ফিকে হতে থাকলে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইরানিদেরকে উদ্বিগ্ন হতে বারণ করেন। দেশের কাজে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন। রাইসির জন্য সবাইকে দোয়া করারও আহ্বান জানান।
হেলিকপ্টারে আরও যারা ছিলেন : হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও আরও কয়েকজনের প্রাণ গেছে। রাইসির সঙ্গে তাবরিজ শহরের জুমার নামাজের ইমাম আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলি আল–ই হাশেম এবং পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর জেনারেল মালেক রহমাতিও ছিলেন। এছাড়া প্রেসিডেন্টের সুরক্ষায় নিয়োজিত ইউনিটের কমান্ডার সরদার সাইয়্যেদ মেহদি মুসাভিও নিহত হয়েছেন। এছাড়া কয়েকজন বডিগার্ড ও হেলিকপ্টার ক্রুও রয়েছে যাদের নামা এখনো জানা যায়নি। প্রেসিডেন্ট রাইসিসহ অন্যদের লাশ উদ্ধার করে তাবরিজে নেওয়া হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর গতকাল সকালে জরুরি বৈঠকে বসে ইরানের মন্ত্রিপরিষদ। পরে তারা একটি বিবৃতি দেন। প্রেসিডেন্ট ও তার সফরসঙ্গীদের মৃত্যুতে বিবৃতিতে শোক জানানো হয়। প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে প্রশাসনিক কোনো কাজে ব্যাঘাত ঘটবে না বলেও জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়।
ইরানে পাঁচ দিনের শোক : প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিসহ তার সফরসঙ্গীরা নিহত হওয়ার ঘটনায় ইরানে পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ইরানের সরকারি ইরনা বার্তা সংস্থায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে খামেনি বলেছেন, আমি ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করছি। ইরানের জনগণের প্রতিও আমার সমবেদনা জানাচ্ছি।
রাইসি নিহত হওয়ায় ঘটনায় শোক জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। তাদের মধ্যে আছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও। সিরিয়া এবং লেবাননও এ ঘটনায় ৩ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে।
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিসহ নিহতদের মৃতদেহ আজ মঙ্গলবার তাবরিজ থেকে উত্তরপূর্বের নগরী মাশহাদে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছে ফার্স নিউজ। মাশহাদে জন্ম এবং বেড়ে উঠেছিলেন রাইসি। তার আগে গতকাল বিকাল ৪টার দিকে তাবরিজ নগরীর একটি প্রার্থনা হলে নিহতদের স্মরণে বড় ধরণের প্রার্থনা ও শোক অনুষ্ঠান আয়োজন হয়। ফার্স নিউজ আরও জানায়, মঙ্গলবার (আজ) স্থানীয় সময় সকাল ৯টার দিকে রাইসি এবং নিহত অন্যান্যদের মৃতদেহ নিয়ে একটি বিশাল মিছিল তাবরিজ মার্টিরস স্কয়ার থেকে নগরীর বিমানবন্দরে যাবে। সেখান থেকে মৃতদেহগুলো মাশহাদ নগরীতে নেওয়া হবে।
এদিকে কী কারণে ওই হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয় তা খুঁজে বের করতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি। ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম নিউজ এজেন্সি জানায়, একজন সামরিক কমান্ডারের নেতৃত্বে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি দল ইস্টার্ন আজারবাইজানের দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলের দুর্ঘটনাস্থলে যাবে।