কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু কালো, পোড়া, ভাঙাচোরা বাড়ি। কিছু কিছু আবার একেবারে ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়ে ধ্বংসস্তূপের চেহারা নিয়েছে। এটা ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের বিভিন্ন জনপদের ছবি। উল্টো দিকে ইরানের রাজধানী শহর তেহরানের কাছে শাহরানের তেলের ভাণ্ডার জ্বলতে থাকার ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। সেই ছবিতে দেখা যায়, কালো ধোঁয়ায় ঢেকেছে রাতের আকাশ। যদিও ইরান জানিয়েছে, শাহরানে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র পড়লেও পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া, তেহরানে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবনে একটি ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে। তাতেও সামান্য কিছু ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি। ইরান–ইসরায়েলের মধ্যে মুহুর্মুহু আক্রমণ, প্রতি আক্রমণের আবহে এখনও পর্যন্ত দু’পক্ষেরই বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েলের সামপ্রতিক হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা ১২৮ জনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে প্রায় ৯০০ জন আহত হয়েছেন। অন্য দিকে, ইরানের প্রত্যাঘাতে ইসরায়েলেও অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে রবিবার পর্যন্ত। একে অপরের উপর হামলায় দু’পক্ষেরই বহু ঘরবাড়ি, বহুতল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিংবা আধভাঙা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এদিকে হামলা না থামালে ইসরায়েলকে ‘আরও কঠোর জবাব’ দেওয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে, ইরানের হামলায় ইসরায়েলে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর ঘটনায় ইরানকে ‘চড়া মূল্য’ দিতে হবে বলে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী।
অপরদিকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ‘শিগগিরই‘ শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের তৃতীয় দিনে ইয়েমেন থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ শুরু হল ইসরায়েলে। একই সঙ্গে তেল আবিব থেকে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথিদের লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালানো হয়েছে। ইসরায়েলের বাহিনী জানিয়েছে, তাদের নিশানায় ছিলেন হুথিদের সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মুহাম্মদ আল–ঘামারি। যদিও ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রে তাঁর কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, এখনও স্পষ্ট নয়।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং সামরিক নেতৃত্বকে ধ্বংসের লক্ষ্যে ইসরায়েল শুক্রবার যে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে, তার জেরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুটি পাল্টাপাল্টি প্রাণঘাতী হামলা অব্যাহত রেখেছে। সিএনএন লিখেছে, ইরান শনিবার রাতভর ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন পাঠিয়েছে। একই সময় ইসরায়েলও ইরানি লক্ষ্যবস্তুর ওপর নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরান দাবি করেছে, তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র এবং একটি তেল ডিপোতে ইসরায়েল আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে, তেল আবিব, হাইফা ও জেরুজালেমের আকাশে শনিবার ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, প্রতিরক্ষামূলক রকেট ও বিস্ফোরণের আলো দেখা যায়।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য লোকাল কল–এর সম্পাদক মেরন রাপোপোর্ট জানিয়েছেন, ইসরায়েলের উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভেদ করে বহু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানায় সাধারণ ইসরায়েলিরা বিস্মিত ও আতঙ্কিত। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, সামরিক বাহিনী এমন আঘাত পূর্বপরিকল্পিত এবং প্রত্যাশিত ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলেও বাস্তবে অনেক ইসরায়েলি হতবাক যে এত সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে আঘাত হেনেছে এবং ক্ষয়ক্ষতি এতটাই ভয়াবহ। রাপোপোর্ট আরও বলেন, এই হামলাগুলো কেবল সাধারণ লক্ষ্যবস্তুতে নয়, বরং কিছু কৌশলগত স্থাপনাতেও সফলভাবে আঘাত হেনেছে। তিনি উল্লেখ করেন, আমরা সবকিছু জানি না, কারণ সেন্সরশিপ অনেক কঠোর। আর যদি কিছু জানিও, তাও প্রকাশ করার অনুমতি নেই। এই সংঘাত থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় কী হতে পারে–এমন প্রশ্নে রাপোপোর্ট বলেন, আমি মনে করি, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি চুক্তিই একমাত্র সমাধান। ইরান আত্মসমর্পণ করবে না, শিগগির কোনো শাসন পরিবর্তনের সম্ভাবনাও নেই, আর ইসরায়েলও পিছিয়ে আসবে না। তাই সমঝোতা ছাড়া বিকল্প কিছু দেখছি না। রাপোপোর্টের এই মন্তব্য ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রাখায় কর্মীদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে জেরুজালেমে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস। এছাড়া কর্মীরা চাইলে তাদের পরিবারের সদস্যদের ইসরায়েলের বাইরে পাঠাতে পারবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। যদিও এই মুহূর্তে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বন্ধ রয়েছে। কাজেই এখন যদি কেউ ইসরায়েল ছাড়তে চান, তাহলে তার হাতে একমাত্র উপায় হল স্থলপথে জর্ডানের মতো প্রতিবেশি দেশে যাওয়া।
অপর এক খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে ইরান। তাদেরকে আলবোর্জ প্রদেশের সাভোজবোলাঘ কাউন্টি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। খবরে আরও বলা হয়েছে যে, সন্দেহভাজন ওই দুই ব্যক্তি আলবোর্জের একটি সেফ হাউসে থেকে মোসাদের পক্ষে কাজ করতো।
ইসরায়েলের হামলার পর ইরানের পরিস্থিতি নিয়ে নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন ইরানের সাবেক যুবরাজ রেজা পাহলভি, যার বাবা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। বিবিসি‘র লরা কুয়েনসবার্গের কাছে ইরানের সাবেক যুবরাজ দাবি করেছেন যে, সামপ্রতিক হামলায় ইরানের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা নিহত হওয়ায় অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে দেশটির সরকার। অন্যদিকে, সরকারের বিরোধিরা আগের চেয়ে বেশি উজ্জীবিত অবস্থায় রয়েছেন। গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে ইরানের সাধারণ মানুষের পাশে থাকার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য যে, শাহের পুত্র রেজা পাহলভি বর্তমানে নির্বাসনে রয়েছেন এবং খোমেনি সরকারের পতন ঘটানোর জন্য পরা শক্তিগুলোকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সামপ্রতিক বছরগুলোতে তাকে ইসরায়েলও সফর করতে দেখা গেছে।
রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা করার ইসরায়েলি প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তা। একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, ইরানিরা এখনো কোনো আমেরিকানকে হত্যা করেনি। যতক্ষণ না তারা করে, ততক্ষণ আমরা তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হত্যার কথা চিন্তাও করছি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তারা আরও জানান, ইসরায়েল সমপ্রতি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থামাতে বড় ধরনের হামলা চালানোর পর, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল তারা খামেনিকে হত্যা করার সুযোগ পেয়েছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন সেই পরিকল্পনা থেকে তাদের সরে আসতে বলে। তবে এই বার্তা ট্রাম্প নিজে সরাসরি দিয়েছেন কিনা, তা স্পষ্ট করা হয়নি। তবে নিশ্চিত করা হয়েছে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্প ঘন ঘন যোগাযোগ রেখেছেন। রয়টার্সের খবরে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ফঙনিউজে দেওয়া সাক্ষাতকারে নেতানিয়াহু বলেন, অনেক কথাই শোনা যায় যেগুলো আদৌ হয়নি, আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। তবে তিনি এটুকু বলেন, আমরা যা করা দরকার, করব। আর যুক্তরাষ্ট্রও জানে তাদের জন্য কী ভালো।