বিজ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস ও আর্থ–সামাজিক বিকাশের ইতিহাস মিলেই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতার ইতিহাস যা ইতিহাসের বস্তুবাদী বিকাশের নির্যাস। কিন্তু ইতিহাসকে আমরা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর শাসনের সময় কাল ধরে পর্বান্তর করি – যা ইতিহাসকে ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রকাশ বা সাবজেক্টিভ বিষয় হিসাবে প্রতিভাত করে। ইতিহাসের কোন নায়ক বা শাসক যতই ক্ষমতাশালী হোক সময়ের স্রোতে তিনি হারিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথের কথায় ইতিহাসের ভবিতব্য হল ‘জগতের যত রাজা মহারাজ/কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ/সকালে ফুটিছে সুখদুখ লাজ-/টুটিছে সন্ধ্যাবেলা’। ইতিহাস নিত্য প্রবহমান সুখ–দুখের, জীবন ও জগতের বিচিত্র ঘটনার নৈর্ব্যক্তিক প্রবাহ মাত্র। চাইলেই তা নিজের মত করে চালিত করা যায় না। তবে কোন কোন সময়ে ইতিহাসে ব্যক্তির প্রবল প্রভাব দেখা যায়। এমনকি ব্যক্তি ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করে থাকেন কিন্তু তিনি তা সঠিকভাবে করতে পারেন শুধু সমকালীন বিজ্ঞানমনস্ক সামাজিক চেতনা ও শ্রেয়োবোধকে অন্তরে ধারণ করে। কালের প্রবাহে তা সামষ্টিক চেতনার অংশ হয়ে পড়ে। ব্যক্তি যতই ক্ষমতার অধিকারী বা জনপ্রিয় হোন বস্তুজগতের তথা সমাজ জীবনের পরিবর্তনশীল স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকতে পারেন না। তারপরেও দেখা যায় অনেকে ইতিহাসে সদর্থক অবদান রেখেও মানবিক রিপুর তাড়নায় সময় ও সমাজকে বা ইতিহাসকে, সামষ্টিক ভাবনাকে আমলে না নিয়ে আপন পথে ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এমনকি সামষ্টিক কল্যাণের জন্যও ব্যক্তিগত মত ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়। ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখল মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল পরিচালক, জীবন নিবেদিত প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বঙ্গবন্ধু দল ও সরকার থেকে একক সিদ্ধান্তে বের করে দিলেন। রেখে দিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চিহ্নিত পাক মার্কিন এজেন্ট খন্দকার মুস্তাককে। সে দিনই স্পষ্ট হল জনপ্রিয়তা অনেক সময় অন্ধ, অবিবেচনা প্রসুত নেতিবাচক কর্তৃত্ববাদে রূপ নেয়। অল্প দিনের মধ্যে তা বিপর্যয় ডেকে আনে। দেশের মুক্তিযুদ্ধের উল্টো পথে যাত্রা কিন্তু সেই শুরু। শেখ হাসিনার দীর্ঘ গণতন্ত্রহীন কর্তৃত্ববাদী শাসনের সময় রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বেশ কয়েকবার লিখেছিলাম ‘ভাবছো হবে তুমি যা চাও/ জগতটাকে তুমিই নাচাও/ দেখবে হঠাৎ নয়ন মেলে/ হয় না যেটা সেটাও হবে’। স্বৈরশাসনের পতনের পরে দেখা গেল ইতিহাসকে আরেক দফা অস্বীকারের পালা শুরু হয়েছে। কুশিক্ষা, সামাজিক হিংসা ও পশ্চাদপদতাকে পুঁজি করে ’৭১ এর পরাজিত শক্তির নেতৃত্বে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জবরদস্তি করে গুঁড়িয়ে দেয়ার উন্মত্ততা। এই হলো কর্তৃত্ববাদে আরেক হিংস্র রূপ। হাস্যকর ব্যাপার হলো কর্তৃত্ববাদীরা নিজেদের ‘কীর্তি’কে চিরস্থায়ী মনে করে।
উপমহাদেশের ঘটনাবলী থেকে এরকম উদাহারণ টেনে আনা যায়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন একজন উদার নৈতিক ও সেকুলার ব্যক্তি কিন্তু ভীষণ কর্তৃত্ববাদী। প্রথম জীবনে কংগ্রেস নেতা হিসাবে খ্যাতি পান কিন্তু কংগ্রেসের রক্ষণশীল নেতৃত্ব তাঁকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। গান্ধীর ভূমিকা ও নেতৃত্ব তাঁর পছন্দ হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজনীতি ছেড়ে লন্ডন চলে যান। ১৯৩০ এর দশকে দেশে ফিরে তিনি মুসলিমলীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ও গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের রাজনীতি শুরু করেন। তাঁর নীতি বিরুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতার পথে পা বাড়িয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেন এবং মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং দ্রুতই তা জনপ্রিয়তা লাভ করে। ব্যক্তিগত জীবনাচারে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু তৈরি করলেন সম্প্রদায়িক দৈত্যের এক রাষ্ট্র। ফলে দ্রুতই বিদ্বেষের দানব শক্তিশালী হয়ে তাঁকে আদর্শগতভাবে হটিয়ে দিল। এক বছরের মধ্যেই চরম অযত্ন অবহেলায় তাঁর মৃত্যু হলো। জিন্নাহর পাকিস্তান সামরিক কর্তৃত্ববাদের কারণে ভাঙল এবং এখন বাকী অংশেও ভাঙনের সুর তীব্র হচ্ছে। অন্যদিকে জন্মলগ্ন থেকে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মোটামুটি সুসমন্বিত অবস্থান ও দীর্ঘ গণতান্ত্রিক শাসনে ভারতের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা আরো গভীর ও যথার্থ হয়ে উঠার বদলে ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব ও পারিবারিক শাসন কংগ্রেসকে নেতৃত্বশুন্য ও দুর্বল করে দেয়। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে কংগ্রেস আর একক দল হিসাবে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে চরম সাম্প্রদায়িক মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি আজ দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন হয়ে নানা পন্থায় বলতে গেলে ভারতকে ‘পাকিস্তান’ বানানোর তথা ধর্ম রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র এখন বাস্তবতা। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতীয় সাংবিধানিক রাষ্ট্রাদর্শের তীব্র বিরোধী হল মোদি সরকার। কৌতুকের বিষয় হলেও এটা সত্য যে মোদি বিরোধী এদেশের ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো মোদির মতই ইহজাগতিকতা বা ধর্ম নিরপেক্ষতার তীব্র বিরোধী। এখানেই এদের গভীর ও অশুভ ঐক্য।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে এর প্রকৃতই বৈষম্য বিরোধী, সাম্য ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করে বিগত সরকার কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তথা ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক বিকাশ সম্পর্কে অনবহিত শাসক গোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদকেই ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত চারটি নিরপেক্ষ নির্বাচনে এ দেশের মানুষ কোন দলকে ৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় দেখতে চায়নি, ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রান্তিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা এতই গভীর যে, প্রচলিত লুটেরা মুক্ত বাজার ব্যবস্থা বদল ছাড়া কোন দলের পক্ষে মানুষের সমর্থন অব্যাহত ভাবে ধরে রাখা অসম্ভব। দুই বৃহৎ দল যেহেতু এই বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থা বদলে বিশ্বাসী নয় ফলে সমস্যা সমাধানে অপারগ দলকে মানুষ দ্বিতীয়বার সমর্থন দেয়নি। হাসিনা সরকার এই জনমতকে উপেক্ষা করে প্রহসনের নির্বাচন করে জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছে।
অন্যদিকে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে ভিন্ন চেহারায় কর্তৃত্ববাদ ও মনোলিথিক মতাদর্শ তথা ধর্মের নামে কর্তৃত্ববাদী একটি শক্তি সামনে এসে সরকারের ভেতরে বাইরে নিজেদের অবস্থান সংহত ও শক্তিশালী করতে চাইছে। প্রতিপক্ষকে ফ্যাসিবাদী ট্যাগিং দিয়ে ‘মব’ তৈরি করে বার বার আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। চরম অসহিষ্ণু ও গণতন্ত্র বিরোধী এই শক্তির হাতে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় বাংলা ও বাঙালির লোক সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য আক্রমণের শিকার হচ্ছে ক্রমাগতভাবে। শুধু রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল, সুফিবাদী সমন্বয়ী মতাদর্শ, লালন ও শাহ আবদুল করিম এর গানের আসর ও মেলা নয়– অসংখ্যমাজার ভাঙা হচ্ছে যার বিরুদ্ধে এই সরকার কোন ব্যবস্থা কোথাও নেয়নি। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু সংখ্যক শিক্ষক ক্রমাগতভাবে অপদস্ত হচ্ছেন যা গণঅভ্যুত্থান ও আন্দোলনের দেশ বাংলাদেশে কখনো দেখা যায়নি। তৈরি হয়েছে এক ভীতিকর পরিবেশ। ভাবভঙ্গী ও কথাবার্তায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের কাছে এসব তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন বিষয় বলে মনে হয়। বস্তু মব বা মবোক্র্যাসি এই শব্দটি এই সময়ে আলোচনায় এসেছে। সবার জানা দরকার মবোক্র্যাসিকে প্রশ্রয় দিয়ে সমাজে ডেমোক্র্যাসি প্রতিষ্ঠার কথা বলা এক হাস্যকর ভণ্ডামি। ভাঙনের উৎকট বিভীষিকা চলতে দিয়ে জাতীয় ঐক্য হয়না–গণতন্ত্র তো দূরের কথা। সামাজিক শুদ্ধতা, সংস্কার ও পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা হলো সংস্কার ও সামাজিক ঐক্যের অপরিহার্য উপাদান। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী হুমকি দিয়ে নিজের ইচ্ছাকে ক্রমাগত ভাবে চাপিয়ে দেয় তা আখেরে ঐ দল বা গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় – তা গত জুলাই–আগস্টে দেখা গেছে। ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হল কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। সমাজের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য হলো এখানে চালাকি, ভণ্ডামি, শঠতা, অন্ধত্ব, ক্ষমতাবাজি শেষ পর্যন্ত টিকে না। দেশে ও সমাজে বিরাজমান চিন্তার বৈপরীত্য, মতাদর্শিক ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা চালু রেখে জাতীয় ঐকমত্য হয়না। সাময়িকভাবে পরিস্থিতির চাপে হয়তো কোন দলিল রচিত হবে কিন্তু তা কতদিন টিকবে প্রশ্ন সাপেক্ষ। মার্কিন অধ্যাপক জনাব আলী রিয়াজ সাহেব তাঁর অগ্রজের মত ডায়লেকটিকসে বিশ্বাসী নয় বলেই মনে হয়। গত ৫৪ বছরে যে দেশ প্রাথমিক শিক্ষার স্বরূপ ও সর্বজনীন ভিত্তি গড়ে তোলার মত মৌলিক কাজটিই করতে পারেনি, যে যার ইচ্ছামত শিশু শিক্ষা পরিচালনা করছে, বিভক্ত করে ফেলছে শিশু কিশোরদের চিন্তা ও মনোজগতিকভাবে সেখানে জাতীয় ঐকমত্য কি করে হয় বোঝা মুশকিল বৈকি। নানা সংস্কার কমিশন হল কিন্তু মৌলিক সংস্কারের জায়গা শিক্ষা সংস্কার কমিশন হল না। এর কারণ ও ভবিতব্য স্পষ্ট।
প্রথমেই বলেছিলাম ইতিহাস হল নৈর্ব্যক্তিক এক বিষয় – বর্তমান এবং অতীতের নিরবচ্ছিন্ন কথোপকথন। বস্তু বিশ্বের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব ব্যক্তি ও সমষ্টির চিন্তাকে নিয়ত প্রভাবিত করে। বিশ্বাসের জোরে বস্তুগত সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই জোর এবং চাপ সমাজকে সাময়িক বিভ্রান্ত করে মাত্র। একইভাবে ব্যক্তির প্রকৃত চরিত্র ও স্বরূপ, লুটেরা কতৃর্ত্বপরায়নতা বস্তুগত কারণেই একদিন প্রকাশ হয়ে পড়ে – কোন চালাকি বা হিপোক্র্যাসি তা শেষ পর্যন্ত আড়াল করতে পারে না। বলা যায় – বাংলাদেশ এই মুহূর্তে হিপোক্র্যাসি, মবোক্র্যাসির এক চুড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করছে। আবার সংস্কারের নামে পতিত সরকারের নয়া উদারবাদী লুটেরা ব্যবস্থা বদল তো নয়ই বরং পোক্তভাবে নতুন মোড়কে তা প্রতিষ্ঠা করার মার্কিন প্রযোজিত এক নাটক দেখছে দেশ ও জাতি।
লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।