ইতিহাসের তৃতীয় চোখ

নাহিদ ধ্রুব | সোমবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ

কোন সময়ের দলিল কিংবা ঐতিহাসিক কোন ঘটনা যদি ফিকশনে পাল্টে দেয়া হয়, তবে ঐ ফিকশন পাবে নতুন ইতিহাসের স্বাদ। অতঃপর জন্ম নেবে অল্টারনেট হিস্টোরি। কেমন হতো যদি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্ছি টাইম ট্রাভেলের সূত্র আবিষ্কার করতেন? কিংবা আমাদের এই বাস্তবতায় যদি ড্রাগনেরা আজও রয়ে যেত, তবে কেমন হতো আজকের পৃথিবী? কেমন হতো আইনস্টাইনের অবজারভেশন অব রিয়েলিটি যদি আলোর গতিতে মানুষকে স্পেস ট্রাভেলের সুযোগ করে দিত ঠিক তখনই? কেমন হতো আজকের পৃথিবী যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জিতে যেত নাৎসিরা? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তরও অজানা।

এমন সব অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই হয়তো শুরু হয়েছিল অল্টারনেট হিস্ট্রির যাত্রা। এমন এক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই হয়তো ফিলিপ কে ডিক লিখেছিলেন, ‘ম্যান ইন দ্যা হাই ক্যাসেল’ উপন্যাসটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ১৫ বছর পরের ঘটনা নিয়েই শুরু হয় এই উপন্যাস। যেখানে দেখানো হয় এঙিস অ্যালিয়েন্সরা জিতে গেছে যুদ্ধ। এই উপন্যাসে দেখানো পৃথিবী অবশ্য আমাদের বর্তমান পৃথিবী থেকে একদমই আলাদা। এডগার এলেন পো’র ড্রিম উইথইন অ্যা ড্রিম’এর মতো তাই এই উপন্যাসকে অল্টারনেট হিস্ট্রির ভেতর অল্টারনেট হিস্ট্রিও বলা যায়। রবার্ট হ্যারিসের ‘ফাদারল্যান্ড’ ও লেন্স ডেইটনের ‘এসএসজিবি’ও কাছাকাছি প্লটকে ভিত্তি করে ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা দুটো উপন্যাস।

মুরাকামি যখন বলছেন, ভিডিও গেইমসই এখন ফিকশনের কাছাকাছি তখন অল্টারনেট হিস্ট্রিকে কেন্দ্র করে পিটার টিয়েরাসের লেখা, ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব জাপান’ বইটির কথা মনে পড়ছে। ‘ম্যান ইন দ্যা হাই ক্যাসেল’ থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া এই বইটিও শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ‘কী হতো’ এই সম্ভাবনা নিয়ে। যদিও এই বইটি দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও দুঃশাসনের অলিগলি ঘুরে অন্বেষণ করেছে আরও বৃহৎ কোন অনুভূতির। উপন্যাসটি অ্যাকশন প্যাকড হওয়ায়, এই উপন্যাস থেকে পরবর্তীতে তৈরি করা হয়েছে ভিডিও গেইমস। কী হতো যদি সব মৃতরাই উঠত জেগে! যদি একটা জম্বি অ্যাপোক্লিপ্স থামাতে পারতো সিভিল ওয়্যার, যদি মৃত কালো এবং আদিবাসীদের পাঠানো হতো জীবিতদের সাথে যুদ্ধ করতে, বর্ণবাদ, সহনশীলতা ও নারীর সংগ্রামকে উপজীব্য করে ‘ড্রেড ন্যাশন’ নামে এমনই এক কাল্পনিক উপন্যাস লিখেছেন জাস্টিনা আয়ারল্যান্ড।

জাদুবাস্তবতা, পরাবাস্তবতা থেকে শুরু করে সায়েন্স ফিকশনের সমস্ত অনুষঙ্গ নিয়েও লেখা হয়েছে অল্টারনেট হিস্টোরি ভিত্তিক ফিকশন। কোলসন হোয়াইটহেডের লেখা ‘দ্যা আন্ডারগ্রাউন্ড রেইলরোড’ উপন্যাসে অ্যামেরিকান বর্ণবাদের ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখক এমন এক প্রোটাগনিস্টের সাহায্য নেন যে একইসাথে টাইম ও স্পেসে ট্রাভেল করেন। সিভিল ওয়্যার শুরুর আগে, আন্ডারগ্রাউন্ড রেল রোড ধরে কৃতদাসরা খুঁজে বের করেছিল লুকিয়ে থাকা ও স্বাধীন রাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার পথ। এই উপন্যাস মূলত ঐ পথকে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে অল্টারনেট হিস্ট্রির দিকে।

অল্টারনেট হিস্ট্রির আরও একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস সুজানা ক্লার্কের লেখা, ‘জোনাথন স্ট্রেঞ্জ অ্যান্ড মিস্টার নরেল’। এই উপন্যাস সম্পর্কে নীল গেইম্যান বলেছেন, এই উপন্যাসটি ফ্যান্টাসি ঘরানায় গত সত্তর বছরের মধ্যে লেখা সেরা ইংরেজি উপন্যাস। হারিয়ে যাওয়া কোন এক ম্যাজিকের সাহায্যে নেপোলিয়নের সাথে ইংরেজদের জয়ের গল্প নিয়েই শেকড় ছড়িয়েছে এই উপন্যাস। সমকালীন সাহিত্যে যখন গ্রাফিক নোভেলের জয়জয়কার, অল্টারনেট হিস্ট্রি নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছে সেখানেও। জেড মার্কুরিও ও ওয়েসলি রবিন্সের লেখা ‘অ্যাসেন্ট’ উপন্যাসে চমৎকার ডিটেলিংইয়ের পাশাপাশি পাঠককে মুগ্ধ করার জন্য আছে দুর্দান্ত সব ছবি।

অল্টারনেট হিস্ট্রি থেকেই মূলত অল্টারনেট ইউনিভার্সের সূচনা। কনটেম্পোরারি লিটারেচার যখন নেটফ্লিঙ, ইউটিউব কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে টক্কর দিয়ে করছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ তখন অল্টারনেট ইউনিভার্স নিঃসন্দেহে হতে পারে একটি নতুন জানালা। স্ট্যান্ডার্ড ফিকশনের সব বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে, ইতিহাস থেকে নির্দিষ্ট একটি ঘটনাকে পাল্টে দিয়ে নতুন ডিসকোর্স তৈরি করে অল্টারনেট হিস্ট্রির সাহায্যে স্পেকুলেটিভ ফিকশনের এই ধারাটাকে করা যেতে পারে আরও সমৃদ্ধ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধচেরি স্ট্রিট মিশন