ইতিহাসের এক চেপে রাখা কাহিনি

কামরুল আনোয়ার চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ

সময়টা ছিল ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আমাদের বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে একটা প্রদেশ। একে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলও বলা হতো। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র দুটি স্বাধীন হলেও রাষ্ট্র দুটোর মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বরাবরই বাধার সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসর কিছু রাষ্ট্র। এসব দেশগুলো বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে, বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় উস্কে দিয়ে এ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষ জিইয়ে রাখে। এর নির্মম শিকার দুটি রাষ্ট্রের হাজার হাজার নিরীহ জনসাধারণ। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সমূহের ষড়ষন্ত্রের আরেকটি প্রকাশ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ। এতে তারা কাশ্মীর সমস্যা উস্কে দিয়ে লাগিয়ে দেয় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্ব বা ধর্মীয় ঐক্যের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) অপরদিকে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান পাখতুনখোয়া) একত্র করে পশ্চিম পাকিস্তান নাম দিয়ে ‘পাকিস্তান’ নামে এক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ সরকারি ও বেসরকারিভাবে লুন্ঠন, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের উপর পাকিস্তান সরকারের শোষণ, বঞ্চনা অত্যাচারের কারণে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ, বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনে নেমে পড়ে। এ দেশে ১৯৫২’ ৫৪’ ৫৬’ ৬১’ ৬৩ সালে বিভিন্ন আন্দোলন সৃষ্টি হয়। ভারত সরকার এ সব ঘটনা সম্পর্কে বেশ সজাগ ছিল।

তাই এ দেশের মানুষের প্রতি তাদের সহানুভূতিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ১৯৬৫ সালের ৬ ই সেপ্টেম্বর লেগে যায় যুদ্ধ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। আক্রমণ শুরু হয় স্থলপথে, বিমান পথে, নৌ পথে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তর্গত হিসেবে বেঙ্গল রেজিমেন্টও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান সরকার বরাবর প্রচার করতো বাঙালিরা ভীরু। তারা যুদ্ধ বিদ্যায় দক্ষ নয়। অথচ পাকিস্তানের বিভিন্ন সেক্টরে বাঙালি সেনাবাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চেয়েও অধিকতর দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের পর পাকিস্তান সরকার অনেক বাঙালি সৈনিককে পদক ও খেতাব দিয়ে সম্মানিত করে। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানে ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু বাংলাদেশে কোন আক্রমণ তারা চালায়নি। এ দেশে যদি ভারত আক্রমণ চালাতো তাহলে কী হত ইতিহাস, ভূগোল ও যুদ্ধ বিজ্ঞান সম্বন্ধে যার সামান্য ধারণা আছে তিনি বুঝে নিতে পারবেন। এ দেশের তখন অস্তিত্ব বলতে কিছু থাকতো না। ভারতের আক্রমণ ঠেকানোর মত কোন শক্তি পাকিস্তানের ছিল না। তৎকালীন বাংলাদেশ ধরতে গেলে পুরোপুরিই অরক্ষিত ছিল। বাংলাদেশের কোন সীমান্তে জোরালো কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলনা বললেই চলে। সরকার পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় অধিকতর তৎপর ছিল। তাই ভারত এদিকে পূর্ব পকিস্তানে শক্তি ও সমরাস্ত্র ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি, কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ দেশের জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় অনূভূতিকে পুঁজি করে ভারত বিরোধী উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য সদা তৎপর ছিল। একদিন পাকিস্তান বাহিনীর একটি বিমান পশ্চিম বঙ্গের বিমান ঘাটিতে বোমা মেরে আসে। ভারতীয় বাহিনী এর বদলাস্বরূপ এ দেশে আক্রমণের প্রস্তুতি নিলে ভারতের তৎকালীন ঋষিতূল্য প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তাদের পূর্ণভাবে বিরত করেন। এসময় এক জনসভায় এ ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন ‘ইস্ট পাকিস্তান কা সাথ হামারা কোই দূষমণি নেহি হ্যায়’ (পূর্ব পাকিস্তানের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই)

ভারত বিরোধী এক বিদ্বেষাত্মক মনোভাব সৃষ্টির জন্য পাকিস্তান সরকার এক অভিনব নাটকীয় ঘটনার সৃষ্টি করে। ভারত কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে বিমান হামলার একটি নাটক সৃষ্টির জন্য পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি বিমান সবার অগোচরে ভারতীয় যুদ্ধ বিমানের মত রঙ করে সাজানো হয়। বিমান বাহিনীর এক ফ্লাইং অফিসার আজিজকে অতি প্রত্যুষে এ বিমান নিয়ে উড্ডয়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। ভোর বেলার সেই অন্ধকারে আজিজও কিছু বুঝতে পারেনি। তাই তাকে কর্তৃপক্ষের হুকুম পালনের জন্য বিমানে উঠে বিমান চালনা করতে হয়। বাংলাদেশের নারায়নগঞ্জের ছেলে আজিজ আকাশে উড্ডয়ন করার সাথে সাথে পাকিস্তানী কয়েকটি যুদ্ধ বিমান তাকে তাড়া করে ও বোমা মেরে ভূপাতিত করে। অফিসার আজিজ কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। পরদিন দেশের সব জাতীয় পত্রপত্রিকায় হেডলাইন হল ‘পাকিস্তানের বৈমানিকের কাছে ভারতীয় বিমান ভূপাতিত’। ঘোড়াশালে বিধ্বস্ত বিমান দেখতে গিয়ে দেখা গেল ভারতীয় বিমান বিধ্বস্ত। কিন্তু মারা গেল পাকিস্তানী পাইলট। প্রত্যক্ষদর্শীরা সবাই বিষ্মিত ও বিভ্রান্ত। জনসাধারণ ও সুধীসমাজ এ খবরে বিভ্রান্ত। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির রক্তচক্ষুর সামনে কারো মুখ খুলে কথা বলার সুযোগ নেই। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘পাকিস্তান নিজ বিমান ভূপাতিত করে ভারতের উপর দোষ চাপাচ্ছে’।

তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলো। বীর বৈমানিকদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করা হলো ঢাকার পুরানো বিমান বন্দর তেজগাঁওএ। মেডেল দিতে ঢাকা এলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল নূর খান। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন জাতীয় পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তানের (স্বাধীনতা উত্তর কালে দৈনিক বাংলা) চীফ রিপোর্টার আলী আশরাফ। জনাব আশরাফ প্রশ্ন রাখলেন নূর খানের কাছে ‘How Aziz was killed?’ নূর খান তখন প্রশ্নটি ছুড়ে দিলেন পাশে দাঁড়ানো গ্রুপ কমান্ডার কুদ্দুসের দিকে। কুদ্দুস বেশ শান্ত ও সহজ ভঙ্গীতে উত্তর দিলেন ‘He was on a Mission।’ তৎকালীন এক ইংরেজী দৈনিক ‘Morning News’ এর চীফ রিপোর্টার শহীদুল হক পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি ভয়ে কাঁপ ছিলেন কারণ ‘Morning News’ পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক কর্মচারীদের বেশিরভাগ ছিলেন অবাঙালি বিহারী। শহীদুল হক পরে আলী আশরাফকে বেশ বকাঝকা করেছিলেন, আশরাফের নিরাপত্তার কথা ভেবে। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের লৌহ শাসনের ছত্রছায়ায় সত্য প্রকাশের কোন অবস্থা ছিল না। তা করলেই নেমে আসতো শাস্তি ও কারাবাস। এ তথ্য দীর্ঘদিন অজানা ছিল। তাই বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আবেদন যথাযথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার শিকার বিমান সেনা আজিজের জীবন ও স্মৃতি সবার কাছে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হোক। তথ্যসূত্র : সাংবাদিক ফজলুল করিম ‘নিরীক্ষা পত্রিকা’।

লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআঞ্জুমান প্রতিষ্ঠা : ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও কোহিনূর প্রেস
পরবর্তী নিবন্ধশিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য জরুরি খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ