চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্পের পথিকৃৎ, এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের অকৃত্রিম সুহৃদ আলহাজ মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৬২ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেছিলেন। মৃত্যুর মাত্র দুইবছর আগে চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে তিনি প্রকাশ করেছিলেন দৈনিক আজাদী। এ অঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ৬৫ বছর আগে পত্রিকা প্রকাশনার মতো দুরূহ কাজ শুরু করেছিলেন শুধুমাত্র চট্টগ্রামকে ভালোবেসে। এর আগে তিনি সাপ্তাহিক কোহিনুর নামেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কোহিনুর লাইব্রেরিও। মানুষের জ্ঞানের চর্চা এবং এ অঞ্চলের অভাব অভিযোগ তুলে ধরার জন্য তিনি পত্রিকা প্রকাশনার মতো একটি অলাভজনক কাজ শুরু করেন। আজকের প্রেক্ষাপটে কল্পনাও করা যাবে না যে, তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশনা কত দুরূহ কাজ ছিল।
রাউজানের সুলতানপুরের প্রত্যন্ত জনপদে জন্ম নেওয়া মেধাবী ছাত্র আবদুল খালেক তৎকালীন নানা সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। স্কুল–কলেজের পাঠ শেষ করে ভারতের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করার পর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। চাকরিকালীন চট্টগ্রামের বিদ্যুতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
পেশাগত জীবন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তান আমলের শোষণ–বঞ্চনা কাছ থেকে দেখেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি তৎকালীন সরকারের অবহেলা তাঁকে কষ্ট দিত। তাই পূর্ব পাকিস্তানের অবহেলিত জনপদ চট্টগ্রামের মানুষের অভাব–অভিযোগ তুলে ধরার পাশাপাশি মানুষকে শিক্ষিত এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য পত্রিকা প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি।
৬৫ বছর আগে এখানকার মানুষ শিক্ষা–দীক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে পত্রিকা প্রকাশনা ছিল অলাভজনক ও অনিশ্চিত একটি পেশা। অথচ সরকারি লোভনীয় ও নিরাপদ চাকরি ছেড়ে আলহাজ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পত্রিকা প্রকাশনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। চট্টগ্রামের শিক্ষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের বিকাশে তিনি কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস, কোহিনুর লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। বের করেন কোহিনুর পত্রিকা।
৬৫ বছর আগের প্রেক্ষাপটে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ ছিল কঠিন কাজ। আজ তা কল্পনাও করা যাবে না। মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামের মানুষের জন্য সেই কঠিন কাজটি বেছে নিয়েছিলেন। কেবল পত্রিকা প্রকাশ, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা বা ছাপাখানা স্থাপন করে ক্ষান্ত হননি, আলোকিত মানুষ তৈরির কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর সহায়তা পেয়ে অনেকেই পরে কবি–সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।
একুশের প্রথম কবিতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ প্রকাশিত হয়েছিল কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে। এই কবিতা প্রকাশের দায়ে কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছিল কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসের মালিক আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মচারীদের। নানা ভোগান্তি সহ্য করেও পত্রিকা প্রকাশনা থেকে পিছপা হননি তিনি। সাপ্তাহিক পত্রিকা কোহিনুরের প্রকাশনার ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদী। তাঁর হাতে গড়া আজাদী গত ৬৪ বছর ধরে এ অঞ্চলের কথা বলে আসছে। এই পত্রিকা আজ পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের মুখপত্রে।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলিয়ে কেরাম হযরতুল আল্লামা ছৈয়দ আহমদ শাহ ছিরিকোটির (র.) এ অঞ্চলের প্রথম খলিফা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও ধর্মভীরু ছিলেন। দেশের বিখ্যাত ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তাঁর শেষশয্যাও রচিত হয়েছে এই বিদ্যাপীঠ অঙ্গনে।
মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ মমত্ব। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মানুষকে ভালোবেসে গেছেন। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের এই কৃতী পুরুষ আন্দরকিল্লাহ জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন আন্দরকিল্লাকে ‘ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চত্বর’ হিসেবে নামকরণ করেছে। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাঁর নামে একটি হলের নামকরণ করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর ধরে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার স্মৃতিবৃত্তি প্রদান করা হয়।