পর্ব–১
ইক্বামতে দ্বীন তথা দ্বীন প্রতিষ্ঠা একটি অন্যতম ফরজ ইবাদত– যা আমরা অনেকেই জানিনা কিংবা জানলেও তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য মহান রাব্বুল ইজ্জত তাঁর পবিত্র কোরআনুল করীমে অত্যন্ত সু’স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য সেই বিধানই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার কাছে ওহী করে পাঠিয়েছি, যার আদেশ আমি ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম (এদের সবাইকে আমি বলেছিলাম), তোমরা এই বিধানকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং (কখনও এতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না)- ’সূরা– আশ শূরা–১৩। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত যেমনি ফরজ বিধান, ইক্বামতে দ্বীন তেমনিই একটি ফরজ বিধান যা উপরে উল্লেখিত আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি। সমস্ত নবী–রাসূলগণ ইক্বামতে দ্বীন করেছেন। বনী ইসরাঈলদেরকে তাঁরা শাসন করেছেন। একজন নবীর ওফাত হলে আরেকজন নবী আসতেন। ইসলামের মূল যে ৫টি স্তম্ভ রয়েছে তা নিজের জীবন, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে যেমনি আমরা প্রয়োগ করে থাকি, তেমনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা একটি অলঙ্গনীয় বিধান ও ফরজ। বরং ইক্বামতের দ্বীনের চূড়ান্ত রূপ ও পরিপূর্ণ বিকাশই হল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা। এটি ছাড়া দ্বীন কখনো পরিপূর্ণ হতে পারে না। আর ইসলামের স্তম্ভগুলো প্রতিষ্ঠার জন্যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলামী অনুশাসন অতীব জরুরী। কেননা নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেটা রাষ্ট্রীয়ভাবে করতে হবে। নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেলে শপিং মল, দোকান–পাট, বাজার, স্কুল প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক–বীমা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসার কার্যক্রম সবখানেই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মূলতবি রাখা চাই। আর এজন্যে সরকারি অধ্যাদেশ চালু করা বাঞ্চনীয়। আর ধীরে ধীরে এতে করে সমাজে নামাজ কায়েম হতে বাধ্য। ঠিক তেমনি রোজা ও যাকাতের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয়ভাবে অধ্যাদেশ চালু হলে সেটাও প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য। তবে এক্ষেত্রে শরীয়াহ্ আইন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বহাল রাখা বাধ্যতামূলক। আর এটা আপনার কিংবা আমার ঘোষণা নয়, এটি স্বয়ং যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, আপনার হায়াত, রিজিক এর মালিক যিনি, জন্ম–মৃত্যুর একচ্ছত্র অধিপতি যিনি, তিনি চিরঞ্জীব আল্লাহতায়ালার ঘোষনা। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, এদেশে অনেক আলেম–ওলামা, শিক্ষিত মহল, সাধারণ মানুষ ইক্বামতে দ্বীনের গুরুত্ব বুঝেনি–কিংবা বুঝার চেষ্টাও করেনি কষ্মিনকালেও। যে ইক্বামতে দ্বীনের জন্য বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ আমাদের প্রাণপ্রিয় পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) খন্দকের যুদ্ধে নামাজ তরক করেছিলেন, বদরের যুদ্ধে রোজা তরক করেছিলেন– সেই ইক্বামতে দ্বীনের গুরুত্ব আমরা বুঝার চেষ্টা কোনদিন করিনি। অথচ ঐ অবস্থায় নামাজ রোজার চেয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার গুরুত্বই ছিল বেশি। আর এই অলঙ্গনীয় ফরজ ইবাদত কিংবা ইক্বামতে দ্বীনকে শুধুমাত্র নাস্তিকরাই অস্বীকার করতে পারে। কোন মুসলিম তা অস্বীকার করতে পারে না। মক্কার কুরাইশরা যখন আমার রাসূল (সাঃ) কে হত্যা কিংবা দেশ ত্যাগে বাধ্য করার পরিকল্পনা করছিল, তখন আমার আল্লাহতায়ালার পরামর্শে নবী মোহাম্মদ (সাঃ) কে মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। আর তখনই সূরা বনী ইসলাঈলের ৮০ নং আয়াতটি নাযিল হয়, ‘তুমি বল, হে আমার রব (যেখানেই নিয়ে যাও), তুমি আমাকে সত্যের সাথে নিয়ে যাও এবং (যেখান থেকেই বের কর) সত্যের সাথেই বের কর এবং তোমার কাছ থেকে আমার জন্যে একটি সাহায্যকারী রাষ্ট্রশক্তি প্রদান কর’। এই আয়াতটির ভাবার্থ হচ্ছে: মক্কা থেকে বের হওয়া এবং মদীনায় প্রবেশ করা। হযরত হাসান বাসরী (রাঃ) বলেন, ‘এই দোয়ার কারণে আল্লাহতায়ালা পারস্য ও রোমদেশ বিজয় এবং ওদের শাসনভার তাঁর উপর প্রদানের ওয়াদা করেন’। হযরত কাতাদাহ (রাঃ) বলেন, ‘এটা তো রাসূল (সাঃ) জানতেন যে, বিজয় লাভ ছাড়া দ্বীনের প্রচার, প্রসার এবং পূর্ণ দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এজন্যই তিনি মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য ও বিজয় কামনা করেছিলেন–যাতে তিনি আল্লাহর কিতাব, তার হুদুদ, শরীয়তের কর্তব্যসমূহ, দ্বীন প্রতিষ্ঠা চালু করতে পারেন। এই বিজয় দানও আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ রহমত। এটা না হলে সবল দুর্বলকে আক্রমণ করত এবং একে অপরকে গ্রাস করে ফেলত। সত্যের সাথে শক্তিও জরুরী, যাতে সত্যের বিরোধীরা জব্দ থাকে এবং তাদের আচরণ স্তব্ধ হয়ে যায়। আর এজন্যেই রাসূল (সাঃ) মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন একমাত্র কোরআনুল করীমই সামগ্রিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। আর কোরআন দিয়েই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। যেখানে চারটি ধর্মের লোকজনের সহাবস্থান ছিল। যেমন– ১। মুসলমান, ২। ইহুদি, ৩। খ্রিস্টান ও ৪। পৌত্তলিক সম্প্রদায়। তারা সবাই আমার রাসূল (সাঃ) কে মদীনার রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন। ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে অনেক সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর বিচ্ছেদকে যে মেনে নিতে হয় তা একটি সত্য ঘটনা দ্বারা বুঝানো যাবে। যেমন: বিখ্যাত সাহাবী, প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, হাফেজে কুরআন, ইয়ারমুকের যুদ্ধের কমান্ডার, ইয়েমেনের গভর্ণর হযরত মু’আয ইবনে জাবেল (রাঃ) কে ইয়েমেনের গভর্ণর হিসাবে পাঠানোর সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, ‘হে মু’আয, ইয়েমেন থেকে ফিরে এসে তুমি আর আমাকে পাবে না। হযরত মু’আয উটের পিঠ থেকে নেমে গেলেন। বললেন: ইয়া রাসূল (সাঃ)-আমি ইয়েমেন যাব না। ইয়েমেনের গভর্ণরশীপ আরেকজনকে দিয়ে দিন। আমি যদি এসে আপনাকে না পাই তাহলে এই গভর্ণরশীপ দিয়ে আমি কি করব? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, আল্লাহর দ্বীনের জন্য রাসূল (সাঃ) এর বিচ্ছেদ বরদাশ্ত কর’। ইসলামের প্রথম শহীদ হযরত সুমাইয়া (রাঃ) ইক্বামতে দ্বীনের জন্য আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছেন। কুখ্যাত কাফের আবু জেহেল হযরত সুমাইয়াকে নির্যাতন করে বেঁধে রেখেছিলেন এবং সে বলছিল: মোহাম্মদ (সাঃ) এর দ্বীন পরিত্যাগ কর। অসীম সাহসী বীর হযরত সুমাইয়া ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে আবু জেহেলের মুখে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। আর সাথে সাথে কুখ্যাত আবু জেহেল মা সুমাইয়ার লজ্জাস্থানে প্রচন্ড আঘাত করে ক্ষত–বিক্ষত করেছিল। আর হযরত সুমাইয়া (রাঃ) আকাশের দিকে শাহাদাত আঙ্গুলি প্রদর্শন করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ আমি সফল হয়েছি, আমি সফল হয়েছি’। তেমনিভাবে হযরত বেলাল (রাঃ) কে তার মনিব ধু ধু মরুভুমিতে প্রচন্ড খরতাপের মধ্যে জীর্ণ–শীর্ণ শরীরে আঘাত করতে করতে রক্তাক্ত করে তুলেছিল। এরপরও হযরত বেলাল (রাঃ) এর মুখ থেকে ‘আহাদুন’ ‘আহাদুন’ শব্দের ঢেউ উঠছিল আর উঠছিল। এই মহান মানুষদের ত্যাগ আর তিতিক্ষার মাধ্যমে ইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনকার আবর দেশে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন্ে মাসুদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) মক্কায় বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেন। সেই সময় বাইতুল্লাহর চারদিকে ৩৬০ টি মূর্তি ছিল । কিন্তু তিনি তাঁর হাতের লাঠি দ্বারা আঘাত করছিলেন, আর মুখে আল্লাহর আয়াতগুলো পাঠ করছিলেন-‘সত্য এসে গেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা তো বিলুপ্ত হয়েই থাকে’– সূরা বনী ইসরাঈল– ৮১। অন্য একটি আয়াতে এসেছে: ‘সত্যের আগমন ঘটেছে এবং মিথ্যা বিদূরিত হয়েছে। মিথ্যা বিদূরিত হয়েই থাকে’। সূরা আস–সাবা– ৪৯। জান্নাত তো এত সহজ নয়, এর জন্যে কঠিন পরিক্ষার মুখোমুখি হতে হবে আমার আল্লাহতায়ারার সামনে, ‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে, তোমরা (এমটি এমনি ) জান্নাতে প্রবেশ করবে ! (অথচ) তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের (বিপদের) মতো কিছুই তোমাদের কাছে এখনো আসেনি, তাদের উপর অভাব, অভিযোগ ও রোগ–ব্যাধি এসেছে। কঠিন নিপীড়নে (তাদের প্রকম্পিত করা হয়েছে) এবং স্বয়ং নবী ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা এই বলে (আর্তনাদ করে ) উঠেছে, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? হ্যাঁ অবশ্যই আসবে–আল্লাহতায়ালার সাহায্য অতি নিকটে’। সূরা– বাকারা–১১৪।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল