ইউক্রেন সমস্যা ও আন্তর্জাতিক লেনদেন

ড. নারায়ন বৈদ্য | মঙ্গলবার , ২২ মার্চ, ২০২২ at ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নিত্যনৈমিত্তিক জীবনধারায় মানুষের নিকট বহুরকমের দ্রব্যের প্রয়োজন হয়। একবার চিন্তা করুন, সকালে উঠে দন্ত মাজন থেকে শুরু করে চা-নাস্তা করতে গিয়ে পেষ্ট, টুথব্রাশ, চা, চিনি, দুধ, আগুন জ্বালানোর জন্য দিয়াশলাই, গ্যাস, হাড়ি, পাতিল আরো কতই না কিছুর প্রয়োজন হয়। এসব জিনিসগুলো দেশে কোন না কোন উৎপাদক উৎপাদন করে এবং তা কিনে নিয়ে আমরা ব্যবহার করি। কিন্তু এসব পণ্যের সবটুকু কিন্তু দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। জনগণের সুবিধার্থে ব্যবসায়ী মহল দেশে এসব অনুৎপাদিত পণ্যগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করে। আবার কোন কোন সময় বিভিন্ন মডেলের সুন্দর সুন্দর পণ্যগুলো ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে আমদানি করে। সরকারও এসব পণ্য আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে। কিন্তু পণ্য আমদানি করতে গিয়ে দেশীয় মুদ্রা বিদেশীরা গ্রহণ করে না। তাছাড়া এলসি খোলার মাধ্যমে আমদানি করার যে নিয়ম তা বিশ্বের অনেক দেশে কার্যকর নয়। কারণ এলসি খোলার মাধ্যমে লেনদেনের সময় লাগে বেশি। অথচ জরুরী ঔষধ ও জীবন রক্ষাকারী পণ্যগুলো দ্রুত আমদানি করতে হয়। ফলে আধুনিক বিশ্বে এলসি খুলে আমদানি করার পদ্ধতি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। দ্রুত লেনদেন করার সুবিধার্থে যে কোন দেশের অর্থ ছাড় দেয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে একটি পদ্ধতি প্রচলন করা হয়। এ পদ্ধতির নাম “দ্যা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন” (SWIFT) সংক্ষেপে বলা হয় সুইফট। বর্তমান বিশ্বে সুইফটের সদস্য সংখ্যা ২০০টি দেশ। এ ২০০টি দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ও অন্যান্য লেনদেন সম্পাদন হয়ে থাকে সুইফটের মাধ্যমে। ২০২১ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ২০০টি দেশের প্রায় ১১ হাজার আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুইফটের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ বার্তা আদান-প্রদান করা হচ্ছে সুইফটের মাধ্যমে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে এ আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে যখন পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবরোধ আরোপ করেছে। এক সময়ের ইউএসএসআর ভেঙে যাওয়ার কারণে ইউক্রেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রাশিয়া বা USSR ভেঙে যাওয়ার কারণে পশ্চিমা দেশগুলো আনন্দিত হয়েছে বেশি। প্রথমতঃ সমাজতান্ত্রিক দেশের মূল কাঠামোতে আঘাত করতে পেরেছে পুঁজিবাদী দেশগুলো। দ্বিতীয়তঃ সুপারপাওয়ার হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে পারার কারণে এখন পুঁজিবাদী দেশগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় বর্তমান রাশিয়া তার সুপারপাওয়ার ফিরে পেতে মরিয়া। তার পাশের রাষ্ট্রকে কিছুতেই ন্যাটোর সদস্য হতে দিতে পারে না। যেহেতু ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধান পশ্চিমা ঘেঁষা সেহেতু তাকে শায়েস্তা করার জন্য এবং পূর্বের পরাশক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য আজ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিন্তু এ যুদ্ধাবস্থায় রাশিয়াকে কাবু করার জন্য পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো ইউক্রেনকে সবধরণের সহায়তা দিচ্ছে এবং নানাভাবে অবরোধ দিচ্ছে রাশিয়ার ওপর। তারই একটি অংশ হিসেবে রাশিয়ার সব লেনদেন যাতে সুইফটের মাধ্যমে না হয় এবং রাশিয়া যাতে দিন দিন দুর্বল হয়ে যায় সেই উদ্দেশ্যে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং যে কোন লেনদেন যাতে সুইফটের মাধ্যমে না হয় সে জন্য পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার সবধরনের সুইফট লেনদেনকে স্থগিত করছে বা বিধিনিষেধ জারি করেছে। বাংলাদেশের অনেক প্রকল্প রাশিয়ার আর্থিক সহযোগিতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। তার মধ্যে বড় প্রকল্প হচ্ছে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কাজেই সুইফটের মাধ্যমে লেনদেন স্থগিত হলে রাশিয়ার অর্থ সাহায্য বাংলাদেশে আসতে পারবে না। ফলে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অগ্রগতিও থেমে যাবে। এরূপ রাশিয়ার আর্থিক সহযোগিতায় বাস্তবায়নকৃত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিও থেমে যাবে।
তবে পৃথিবী এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের কবলে নেই। সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাও এখন আর নিছক ডলার ও সুইফট নির্ভর নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রবর্তিত ডিজিটাল মুদ্রার কল্যাণে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থা পাশ কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ একাধিক দেশ ইউক্রেন সংকটের জেরে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পপতির সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি কয়েকটি দেশ রাশিয়ার পর্যটকদের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু তাতে প্রাথমিকভাবে কিছুটা অসুবিধায় পড়লেও বিটকয়েন (এক প্রকার ডিজিটাল মুদ্রা)কে হাতিয়ার করে রাশিয়ার নাগরিকদের অনেকেই সেই নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সক্ষম হয়েছে।
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর বড় খবর হলো, রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকে বাদ দেয়া। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো পুরো বিশ্বে আর কাজ করতে পারবে না। ফলে বাধাপ্রাপ্ত হবে রাশিয়ার আমদানি রপ্তানি। একই সাথে রুশ ধনকুবেরদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক বাজারের সম্পদ ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন রুশ গ্যাস ও তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। সুইফটের মাধ্যমেই তারা রুশ কোম্পানিগুলোর পাওনা মেটায়। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেকেই রাশিয়াকে সুইফট থেকে বাদ দেয়ার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও বিশাল বাণিজ্যিক ক্ষতি হতে পরে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সুইফটের সদর দপ্তর ব্রাসেলসে। কিন্তু এর তথ্যভান্ডার যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়। ফলে বিশ্বের প্রায় সব আর্থিক লেনদেন-নজরদারি করার সুযোগ পায় যুক্তরাষ্ট্র। ইহাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান হাতিয়ার। এ হাতিয়ারকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও যারা ইরানের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন করেছে, তাদের কাছ থেকে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার জরিমানা আদায় করেছে। শুধু এটা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিকট আরো দুইটি হাতিয়ার রয়েছে। এদের একটি হয় ডলার ও অন্যটি হয় চিপস (CHIPS- ক্লিয়ারিং হাউস ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিষ্টেম)। চিপস হয় বিশ্বের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক ক্লাবের মতো। এ ক্লাবের সদস্যসংখ্যা ৪৩। এর মাধ্যমে লেনদেন করতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভে হিসাব খুলে আগে থেকে অর্থ রাখতে হয়। চিপসের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার লেনদেন হয়। এর সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রের কার্যালয় খুলতে হয়। আর সবকিছু পরিচারিত হয় মার্কিন আইন অনুসারে।
অপরপক্ষে চীন এ বিষয়টি লক্ষ্য করে তারা এক ধরনের লেনদেনের প্রক্রিয়া গড়ে তোলেছে। চীন যে সিস্‌টেমটি গড়ে তুলেছে সেইটির নাম হয় ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিষ্টেম বা সিআইপিএস। এখন রাশিয়ার ব্যাংকগুলো নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসার কারণে তারা এর বিকল্প হিসেবে সিআইপিএসকে বেছে নিতে পারে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ডলারের বিপরীতে রাশিয়ার রুবলের চেয়ে চীনের মুদ্রা ইউয়ান এর গুরুত্ব বেশি হয়ে যাবে। ফলে বিশ্বে ডলারের বিপরীতে ইউয়ানকে অনেক দেশ বেছে নিতে পারে। তবে এখনো চীনের মুদ্রা ইউয়ান এ পর্যায়ে আসেনি। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার প্রায় ২ শতাংশের কম। যেখানে মার্কিন ডলারের ব্যবহার প্রায় ৪০ শতাংশ। এমনকি ইউরো, পাউন্ড এবং জাপানি মুদ্রা ইয়েনের চেয়ে পিছিয়ে আছে চীনের মুদ্রা ইউয়ান। তবুও সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সম্প্রতি রাশিয়ার ২৩টি ব্যাংক সিআইপিএস ব্যবস্থায় যোগ দিয়েছে। বিপরীতে কেবল ব্যাংক অব চায়না রাশিয়ার এসপিএফএস ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে।
আবার ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমেও লেনদেনের সম্ভাবনা রয়েছে। ডিজিটাল মুদ্রা হলো ইন্টারনেট ভিত্তিক মুদ্রা, যেমন- বিটকয়েন। তবে এ মুদ্রা হয় বেসরকারি মুদ্রা। আর সরকারি ডিজিটাল মুদ্রা হয় ডিজিটাল ইউয়ান। এ ডিজিটাল ইউয়ানের জোরে চীন আন্তর্জাতিক লেনদেনে সুইফটের বিকল্প হিসেবে সিআইপিএস কে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ডিজিটাল মুদ্রার যুগে গ্রাহককে বাণিজ্যিক ব্যাংকে হিসাব খুলতে হবে না। তারা সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে লেনদেন করবেন। মাঝখানে থাকবে আলি পে বা ভেনমোর নামক অ্যাপ। চেক লেখা বা অনলাইনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অর্থ পরিশোধ করার বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরবরাহ করা ডিজিটাল মুদ্রায় সরাসরি লেনদেন করা যাবে। তখন আর সুইফটের প্রয়োজন হবে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন সম্পন্ন হয়ে যাবে। অতএব ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যে বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে তা হয়ে যাবে হিতে বিপরীত। চীনের ইউয়ান মুদ্রা একবার আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ডলারের আধিপত্য আস্তে আস্তে হ্রাস পাবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধচা শিল্প : বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এগিয়ে চলছে বীরদর্পে
পরবর্তী নিবন্ধমো. আলম কাজল