ইউক্রেন যুদ্ধ: অর্থনৈতিক দুর্যোগ ও মানবিক বিপর্যয়

ড. নারায়ন বৈদ্য | সোমবার , ২১ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবী ছিল দুইটি বলয়ে বিভক্ত। একদিকে ছিল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা দেশগুলো, অন্যদিকে ছিল সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার দেশগুলো। একসময়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ শাসন করতো রাজা বা মহারাজারা। তাঁদের কথায় ছিল আইন। ছোটকালে একটি কবিতা পড়েছিলাম রাজাদের ফরমাইশ সম্পর্কে। যতটুকু মনে পড়ে ঐ কবিতার শুরুটা ছিল এরকম– “কাঁদতে কেহ পারবে নাকো যতই মরুক শোকে, হাসবে আমার সকল প্রজা হাসবে যতই দুঃখে”। এ কবিতার পংক্তি থেকে স্পষ্ট যে, রাজার কথায় ছিল আইন। সমগ্র বিশ্বে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। মানুষ চলার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, সম্পদ অধিকারের স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা ইত্যাদি সম্পর্কে সজাগ হতে থাকে। ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যাওয়ার পর অবশেষে রাজা বা মহারাজার কবল থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার চলে আসে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর। রাজ্য বা রাজা প্রথা আস্তে আস্তে বিলোপ হয়ে যায়। কোন কোন দেশে এখনো রাজা বহাল তবিয়তে থাকলেও এদের প্রথাগত ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোন ক্ষমতা নেই। এভাবে জন্ম হয় গণতন্ত্রের। এই গণতন্ত্রে বিশাল অসুবিধা হলো যে, দেশের অধিকাংশ জনগণ যদি অশিক্ষিত হয় তবে সেই দেশের গণতন্ত্র হয় অশিক্ষিত বা মূর্খের শাসন। তাছাড়া গণতন্ত্রের নামে কিছু ধূর্ত লোক সমপ্রবাহিত আবহাওয়াকে কাজে লাগিয়ে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে প্রচুর অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়ে যায়। দেশের অধিকাংশ জনগণ থাকে দরিদ্র বা অতি দরিদ্র। এ অবস্থায় বৈষম্য এতই প্রকট হয় যে, যা ভুপেন হাজারিকার গানের কলিতে তা ষ্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি তাঁর এক গানের কলিতে বলেছেন– “আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, তার ছায়াতে দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী,” এ গানের কথায় পুঁজিবাদী বিশ্বের বিশাল বৈষম্য ফুটে উঠেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বে একদিকে থাকে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রে অবৈধ আয়ের নরনারীরা। আর অপরদিকে থাকে বিশাল জনগোষ্ঠী যাদের খাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাঁরা অতি দরিদ্র। বিশাল অট্টালিকার ছায়াতে গৃহহীন নরনারীরা রাত্রিযাপন করে। অথবা নিজদের বাসস্থানের জন্য বস্তি এলাকাকে বেছে নেয়। এ সত্যকে উপলব্ধি করে কার্ল মার্ক্স নামক একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতিবিদ ‘DAS CAPITAL’নামক এক গ্রন্থ রচনা করেন। দীর্ঘ ২০ বছর ইংল্যান্ডের বৃটিশ মিউজিয়ামে বসে বসে পুুঁজিবাদী বিশ্বের দুর্বলতা এবং এ সমাজব্যবস্থা কিভাবে দরিদ্র শ্রেণিকে শোষণ করে তা উক্ত গ্রন্থে তুলে ধরেন। বিশ্বের প্রতি দেশে ধনী শ্রেণির নিকট দরিদ্র শ্রেণি কিভাবে শোষিত হয় তার ধারাবাহিক ইতিহাস তিনি ‘DAS CAPITAL’ এ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এ পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণিস্বার্থের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস এবং পুঁজিপতি কর্তৃক দরিদ্র শ্রেণিকে শোষণের ইতিহাস। তাঁর এ গ্রন্থ প্রকাশের সাথে সাথে সমগ্র পৃথিবীতে হৈচৈ পড়ে যায়। বিশ্বের কোন না কোন অংশে বিপ্লবের ঝড় উঠে। এ নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম হচ্ছে সমাজতন্ত্র। এর ধারাবাহিকতায় রাশিয়া, চীন, পোল্যান্ড, উত্তর কোরিয়াসহ অনেক রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাকে গ্রহণ করে। এর পরবর্তী সমগ্র বিশ্ব দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং অপরটি হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে দ্রুত বিজ্ঞানের অগ্রগতি হতে থাকে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে পুঁজিবাদী বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সমভাবে এগিয়ে যেতে থাকে। আরম্ভ হয় দুই বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে। এ প্রতিযোগিতা আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে। শুরু হয় দুই বিশ্বের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে এশিয়া মহাদেশের অর্ধেকাংশও ইউরোপের প্রায় অর্ধেকাংশ নিয়ে গঠিত রাশিয়া ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে যায়। একটি রাশিয়া ভেঙ্গে একাধিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আজকের ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়া থেকে বের হয়ে আসা একটি রাষ্ট্র যা রাশিয়ার পাশে অবস্থিত।

প্রায় ত্রিশ বছর ধরে বৃহত্তর রাশিয়ার অঞ্চলে নবগঠিত রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিপত্তি ঘটে NATO (North Atlantic Treaty Organization) এর সদস্য পদ নিয়ে। ন্যাটো হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর এমন একটি সংগঠন যা যে কোন অবস্থায় পরষ্পরের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করতে বদ্ধপরিকর। ১৯৪৯ সালে যখন ন্যাটো গঠিত হয় তখন উক্ত সংস্থার ফাউন্ডার মেম্বার ছিল ১২টি দেশ। এ বারটি দেশ হয়, বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালী, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পুর্তগাল, বৃটেন ও আমেরিকা। ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল তারিখে ওয়াশিংটন ডিসিতে উক্ত দেশসমূহের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা এক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ন্যাটো আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে গ্রীস, তুরস্ক, ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৫৫ সালে জার্মানী, ১৯৮২ সালে স্পেন, ১৯৯৯ সালে চাকিয়া [CZECHIA যার রাজধানী হয় PRAGUE এবং লোকসংখ্যা হয় ১.৪ মিলিয়ন], হাঙ্গেরী, পোলান্ড, ২০০৪ সালে বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, ল্যাটভিয়া, লিথোনিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, ২০০৯ সালে আলভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ২০১৭ সালে মন্টিনিগ্রো (MONTENEGRO), ২০২০ সালে নর্থ মেসিডোনিয়া এবং ২০২৩ সালে ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে। বর্তমানে ন্যাটোর মোট সদস্যসংখ্যা ৩১টি দেশ। এ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম ও প্রধান শর্ত বা সমঝোতা হলো যে, ন্যাটোর সদস্যভূক্ত কোন দেশ যদি অন্যকোন দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে ন্যাটোর প্রত্যেকটি দেশ তা প্রতিহত করবে। যে কারণে ন্যাটোর সদস্যভূক্ত কোন দেশ অন্য কোন দেশ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে না। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ ইউক্রেন অনেকটা হঠাৎ করে রাশিয়ার বিরোদ্ধাচরণ করে ন্যাটোর সদস্যপত্র গ্রহণের জন্য আবেদন করে। বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে রাশিয়া এ অবস্থাকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে তবে ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য বা আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স যে কোন সময় ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে রাশিয়াকে আক্রমণ করতে পারে। অথবা রাশিয়ার পাশে এসে (ইউক্রেন এসে) রাশিয়ার ওপর খবরদারী করতে পারে। এ অবস্থাকে রাশিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। এ কারণে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনকে শায়েস্তা করার জন্য রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে।

ইউক্রেন হচ্ছে বিশাল একটি দেশ যা বর্তমান রাশিয়ার আয়তনের প্রায় সমান। এ অঞ্চলের লোকসংখ্যা এতই স্বল্প যে, বিস্তীর্ণ এলাকায় খাদ্য শস্যের ব্যাপক চাষাবাদ হওয়া সত্ত্বেও এখনও প্রচুর এলাকা খালি পড়ে আছে। ইউক্রেনে যে পরিমাণ খাদ্য শস্য উৎপাদন হয় তার সিংহভাগ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এ কারণে ইউক্রেনকে বিশ্বের খাদ্যভান্ডার বলা হয়। কিন্তু রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশাল পরিমাণ খাদ্য অন্য দেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি। ফলে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্য শস্য ইউক্রেনে গুদামজাত হয়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। এমতঅবস্থায় বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। সমগ্র বিশ্বে খাদ্য পণ্যের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। অথচ যুদ্ধের কারণে কোন জাহাজ ইউক্রেন থেকে খাদ্য বহন করতে পারছে না। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তুরস্ক, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সাথে আলোচনা করে ইউক্রেন থেকে খাদ্য রপ্তানি ব্যবস্থা করে। শর্ত ছিল যে, খাদ্য রপ্তানিকৃত জাহাজকে কোন দেশ আক্রমণ করবে না। অবশ্য এরূপ চুক্তির মেয়াদ ছিল তিন মাস। এ তিনমাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি জাহাজ খাদ্য নিয়ে ইউক্রেন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাত্রা করে। কিন্তু খাদ্যের দাম যে পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, খাদ্য রপ্তানি হওয়ার পরে খাদ্যের দাম তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসেনি। ফলে সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্যসামগ্রীর দামের পরিবর্তনের কারণে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসেরও পরিবর্তন এসেছে। পূর্বে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ২০ শতাংশ তা বেড়ে হয়েছে ৩০ শতাংশ। যদিও সরকারি হিসেবে তা দেখানো হয় না। বিশ্বের প্রতিটি দেশে বিশেষ করে এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোতে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে অধিক। অথচ ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলো হয় ধনী বা অতি ধনী। তারা প্রতিযোগিতায় আছে তাদের মর্যাদাবোধ নিয়ে। ইউক্রেনকে অবশ্যই ন্যাটোর সদস্য করতে হবে। আর রাশিয়া আছে আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে। ন্যাটোর কর্তৃত্ব রাশিয়া কিছুতেই মানতে চায় না। এ যে মর্যাদাবোধের লড়াই তার বলি হচ্ছে এশিয়ার ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলো। ফলে এশিয়া, আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক বিপর্যয়।

শুধু অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়, মানবিক বিপর্যয়ও দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ৫০০ শিশুসহ ৯ হাজারেরও বেশি মানুষ। এ বেসামরিক মানুষ ও শিশুগুলোর কোন অপরাধ ছিল না। শুধুমাত্র পারষ্পরিক মর্যাদাবোধের দ্বন্দ্ব, ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বা না হওয়া এবং ব্যক্তির (নেতাদের) ক্ষুব্ধ মন এ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। অবশ্য এ আলোচনায় অন্যান্য কারণগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেই কারণগুলো মুখ্য নয় বরং গৌণ। আসল কারণ হচ্ছে ন্যাটোর সদস্যপদ গ্রহণ করা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একমাত্র হিটলারের রাগান্বিত সিদ্ধান্তের কারণে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। হিটলার পরাজিত হওয়ার কারণে তাঁর সমর্থনকারীদের এখনো মাঝে মধ্যে বিচারের মুখোমুখী করা হয়। হিটলার যদি পরাজিত না হতো তবে বিচারও হতো না। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে মৃত্যুবরণকারী মানুষের এবং শিশুদের বিচার হবে কি হবে না তা নির্ভর করবে জয় পরাজয়ের ওপর। যদি বিচার হয় তবে একই সাথে ইন্ধনকারীদেরও বিচার হওয়া উচিত।

লেখক : প্রাবন্ধিক; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি

পূর্ববর্তী নিবন্ধলোকমান হাকিম স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে দেশে উচ্চশিক্ষা কেমন হতো?