‘ই-পারিবারিক আদালত’ অন্তর্বর্তী সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ

আলমগীর নূর | শুক্রবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বিচারিক প্রক্রিয়াকে আধুনিকায়ন এবং বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত পারিবারিক আদালতব্যবস্থা দেশের বিচার ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এই পদক্ষেপ পারিবারিক মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয় এবং শারীরিক কষ্ট কমানোর এক নিশ্চিত পথ দেখাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ২৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ইপারিবারিক আদালত উদ্বোধন করেন। তাঁর মতে, এই যুগান্তকারী উদ্যোগ বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘব এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় গতি আনবে, যা দেশের বিচার ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ গুরুত্ব : দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও প্রধান বন্দর নগরী চট্টগ্রামে জনসংখ্যার আধিক্য এবং ভৌগোলিক সুবিস্তৃতির কারণে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি প্রায়শই প্রকট। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটির মতো দূরবর্তী জেলা থেকেও বহু মানুষ চট্টগ্রামে পারিবারিক মামলা পরিচালনার জন্য আসেন। পারিবারিক আদালতচালুর ফলে এখন বিচারপ্রার্থীরা নিজের বাসা বা অফিস থেকেই হাজিরা ও শুনানি দিতে পারবেন, যা চট্টগ্রামের দূরবর্তী এলাকা এবং দ্বীপসমূহের (যেমন সন্দ্বীপ) মানুষের যাতায়াত খরচ ও সময় বহুলাংশে বাঁচাবে। প্রসঙ্গক্রমে, পারিবারিক আদালতের আইনজীবী সজীব মাহমুদ আলম বলেন, এই ব্যবস্থায় মামলার নথিপত্র একটি সুরক্ষিত সার্ভারে সংরক্ষিত থাকবে। এটি নথি হারানোর ঝুঁকি দূর করবে এবং জনবহুল ও ব্যস্ত চট্টগ্রাম আদালতের জন্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ও দুর্নীতির পথ সংকুচিত করতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ২৪ ঘণ্টা রেজিস্ট্রেশন এবং অনলাইন শিডিউলিংয়ের সুবিধা খাকবে যা মামলার প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও কার্যকর করবে। তবে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই ইআদালতের ধারণা সম্পর্কে কিছু চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথও উল্লেখ করেছেন। তিনি পারিবারিক মামলার ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইড (বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা) বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছেন, যা প্রাথমিকভাবে ২০টি জেলায় চালু হয়েছে। এই পদক্ষেপ দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম করবে এবং সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী আগামীতে একতৃতীয়াংশ মামলা লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে সমাধান হবে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বলেছেন, ‘আদালত চালুর এই উদ্যোগ টিকিয়ে রাখতে পারলে তা বিপ্লব হবে। তবে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে প্রবীণ আইনজীবীরা প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত না হওয়ায় প্রাথমিকভাবে অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে, অন্তর্বর্তী সরকার এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির যৌথ উদ্যোগে নিবিড় প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা কর্মসূচি চালু করা আবশ্যক। পাশাপাশি, দেশের প্রতিটি আদালতকে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম আদালত ভবনগুলোতে, দ্রুত আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তি, শক্তিশালী সার্ভার এবং নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ ও বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সতর্কবাণী মেনে নিয়ে, সরকারের পরিবর্তন হলেও অর্থাৎ আগামীর নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা যেন এই ভালো উদ্যোগটি অব্যাহত থাকে, সে জন্য একটি শক্তিশালী আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা দরকার। ইপারিবারিক আদালত কেবল একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং নারী ও শিশুর প্রতি সংবেদনশীল এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার একটি সামাজিক প্রতিশ্রুতি। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে এই ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন করা গেলে সারাদেশে দ্রুত প্রসারে অনুপ্রেরণা যোগাবে। শুধু চট্টগ্রামবাসীই নয়, পুরো দেশবাসী এই উদ্যোগের দ্রুত, কার্যকর এবং টেকসই বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করে।

লেখক: সাংবাদিক, ব্যুরো প্রধান, দৈনিক মানবকণ্ঠ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআকাশ ছোঁয়ার গল্প
পরবর্তী নিবন্ধরেস্তোরাঁর নিস্তব্ধ টেবিলে