স্বানামখ্যাত লেখক, অনুসন্ধিৎসু গবেষক, ইতিহাসবিদ, প্রাবন্ধিক, উপভাষা চর্চায় ও অভিধান রচনায় অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা আহমেদ আমিন চৌধুরী ১৯৫০ সালের ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম রাউজানের নোয়াজিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গর্বিত পিতা দেশনন্দিত ইতিহাসবিদ, প্রখ্যাত লেখক, গবেষক, বিশেষত চট্টলবিদ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মরণোত্তর ‘একুশে পদক’প্রাপ্ত গুণিজন আবদুল হক চৌধুরীর (১৯২২–১৯৯৪) সুযোগ্য সন্তান আহমেদ আমিন চৌধুরী। পিতার পদাঙ্ক স্মরণ করেই সাহিত্য–সংস্কৃতি–স্থানীয় ইতিহাস–ঐতিহ্য, ভাষাতত্ত্ব, লোকতত্ত্্ব, ফোকলোর এবং উপভাষা চর্চায় চট্টগ্রাম ও সিলেটীসহ কয়েকটি অভিধান রচনার মধ্য দিয়ে পথিকৃৎ হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেছেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী আহমেদ আমিন চৌধুরী ১৯৬৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি পুলিশ সার্ভিসে সাব–ইন্সপেক্টর ক্যাডেট হিসেবে রাজশাহী সারদা পুলিশ একাডেমিতে যোগদান করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মদুনাঘাট পাওয়ার স্টেশন অপারেশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। দেশ স্বাধীনের পর তিনি ১৯৭৮ সালে সহকারী পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পান এবং ২০০০ সালের ১৪ জানুয়ারি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কুমিল্লা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, পেশাগত জীবনে তিনি ১৯৭৬ সালে মালয়েশিয়ায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আফ্রিকার নামিবিয়ার স্বাধীনতা প্রক্রিয়ায় ‘আনটাগ’ মিশনে কর্মরত ছিলেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত সুনাম, সততা, নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন।
পুলিশের অত্যন্ত দায়িত্বশীল, কর্তব্যনিষ্ঠ ও কর্মব্যস্ততার চাকরিতে সংযুক্ত থেকে অবসরের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত থেকে পিতার মতোই তিনি একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত লেখক, গবেষক, পণ্ডিত, ভাষাবিদ, উপভাষা বিশারদ ও অভিধান রচনায় বিশেষজ্ঞসহ তাঁর নিজ পেশাভিত্তিক কয়েকটি গ্রন্থ রচনায় তিনি দেশ ও বিদেশে খ্যাতি ও সুনামের অধিকারী হয়েছেন। এ বিষয়টি অবশ্যই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অনুকরণীয় ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। চাকরিরত অবস্থায় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বলা যায়, প্রথম গ্রন্থেই তিনি বাজিমাত করেছেন এবং বিদগ্ধ পাঠক ও পণ্ডিত সমাজে সাদরে অভিনন্দিত হয়েছেন। তারপর আমৃত্যু তাঁর ১৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রত্যেকটি গ্রন্থেই তিনি তাঁর স্বকীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। এসব গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যানুসন্ধানী গবেষক হিসেবে সকল বাঙালির ধন্যবাদার্হ হবেন তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই।
তাঁর রচিত চট্টগ্রামী আঞ্চলিক ভাষার সর্বপ্রথম অভিধান বা সংকলিত শব্দকোষ– ‘চট্টগ্রামী বাংলার শব্দসম্ভার’ (১৯৯৮) এ গ্রন্থটির সংশোধিত ও পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ ‘চট্টগ্রামী ভাষার অভিধান ও লোকাচার’ (২০০৯) গ্রন্থে দেশনন্দিত ভাষাতাত্ত্বিক, লেখক–গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের কৃতী শিক্ষক এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচলক প্রফেসর মনসুর মুসা অত্যন্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও যুক্তনিষ্ঠ মন্তব্য করেছেন:
‘চট্টগ্রামের ভাষা–সাহিত্য–সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একজন নিষ্ঠাবান গবেষক ছিলেন আবদুল হক চৌধুরী। সারাজীবনের সাধনায় তিনি চট্টগ্রামের বহু মূল্যবান ঐতিহ্যকে বিনষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে গেছেন। জনাব আহমেদ আমিন চৌধুরী পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, প্রথাগত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অবস্থান করেও নীরবে গবেষণা করে যাচ্ছেন। তাঁর সাধনা তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য পেয়ে প্রসারিত করবে বলে আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করি।’
উল্লেখ্য, লেখক তাঁর এ গ্রন্থে মোট ১৫,৬০০টি শব্দসম্ভার অন্তর্ভুক্ত করে অত্যন্ত দক্ষতা ও মেধাবী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এজন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই।
তাঁর আরেকটি খুবই উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় লোকসাহিত্য বিষয়ক প্রিয় গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামী ডাক–দিস্তান ধাঁধাঁ ও হাস্তর’ (২০১০) সম্পর্কে প্রখ্যাত পণ্ডিত, গবেষক ও ফোকলোরবিদ, লোকবিজ্ঞানী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফোকলোর বিভাগের তৎকালীন সভাপতি প্রফেসর ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী চমৎকার ও মননশীল মন্তব্য করেছেন :
‘চট্টগ্রামী ডাক–দিস্তান ধাঁধাঁ ও হাস্তর’ গ্রন্থখানি চট্টগ্রামী ভাষার এক অসাধারণ ‘আর্কাইভাল কালেকশন’। এগুলো সংগ্রহ করে সংকলিত করায়, বড়ো এক জাতীয় দায়িত্ব পালন করলেন আহমেদ আমিন চৌধুরী।’
তিনি মাত্র ১৪০ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে ২০৭টি প্রবাদ–প্রবচন, ২৩৩টি ধাঁধাঁ এবং ১৭২টি হাস্তর (শাস্ত্র), ২৪টি চিঁহি, খেলার চেখ বা বোল এবং শেষ অধ্যায়ে কিছু ছড়া সংকলিত করেছেন। এসব দুর্লভ সংগ্রহ এবং প্রকাশের জন্য ঐতিহ্যানুসন্ধানী সকল বাঙালির কাছে তিনি অভিনন্দিত হবেন। তাঁর এ লোক–উপাদান ভিত্তিক গ্রন্থ রচনার সারবত্তা বা সারকথা এমনি ভাবেই শিল্পীত জীবনবোধ একজন লোকবিজ্ঞানীর মতই প্রতিভাত হয়েছে।
আহমেদ আমিন চৌধুরী আরো দু’টি গ্রন্থ রচনা করে জাতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছেন। বিশেষত– তাঁর ‘বাংলাদেশ পুলিশ লেখক অভিধান’ গ্রন্থটি দেশ ও বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে। এ গ্রন্থে তিনি ২২০জন পুলিশ লেখক সম্পর্কে তথ্য–উপাত্ত, ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত এবং গ্রন্থ তালিকা সন্বিবেশিত করে লেখক অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। এসঙ্গে ২২জন পিএইচ.ডি ডিগ্রিধারী লেখক পুলিশ অফিসারেরও পরিচিতি ও দুষ্প্রাপ্য ছবিসমূহ আমাদের আলোড়িত করেছে। তাঁর এ গ্রন্থটি সম্পর্কে এ নিবন্ধের লেখক তাঁর ‘কথামুখ’ লেখায় অভিমত ব্যক্ত করেছেন :
স্বনামখ্যাত লেখক ‘বাংলাদেশ পুলিশ লেখক অভিধান’ সর্বপ্রথম রচনা, সংকলন, সম্পাদনা ও প্রকাশ করে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনীতে দু’শতাধিক লেখক রয়েছেন এবং তাঁদের রচনায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়েছে। যা পূর্বে আমরা তেমন জানতাম না বললেই চলে। সেখানে তিনি তাঁর অসাধারণ ও অসামান্য কর্মপ্রয়াস বা অবদান–এ বাহিনীকে আলোকিত নতুন পথের সন্ধান দেবে। সেই আলোয় তিনি নিজেও উদ্ভাসিত হবেন। … বাংলার সামগ্রিক ইতিহাসে পুলিশের ভূমিকা বা আনুষঙ্গিক বিষয়ক ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য তাঁর এ গ্রন্থটি অপরিহার্য সূত্র হিসেবে যে বিবেচিত হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।’
তৎকালীন পুলিশের আইজিপি জনাব এ. কে. এম শহীদুল হক বিপিএম, পিপিএম বিগত ১৩.০৮.২০১৭ তারিখেও গ্রন্থটি ও লেখকের ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, কেননা, ‘তাঁরই উদ্যোগে প্রথমবার এই লেখক অভিধান প্রণীত হচ্ছে।’
লেখকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য মূল্যবান গ্রন্থ সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে দু’টি কথা বলার চেষ্টা করবো। তবে, রাজশাহী ‘পুলিশ একাডেমি সারদা ও ৭১ এর প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থটি নানা কারণে জাতীয় জীবনে একটি অমূল্য দলিল হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য, ১৯১২ সালে ব্রিটিশরাজ পদ্মাবিধৌত রাজশাহীর সারদায় অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর স্থানে পুলিশ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই একাডেমিতে লেখক ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ৭১–এ মুক্তিযুদ্ধের সংকটকালে পুলিশ একাডেমিতে এবং তদসংলগ্ন গ্রামগুলোতে পাকিস্তানি নরখাদকদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ নানাবিধ মানবতাবিরোধী কার্যক্রম, নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যাসহ সেসব নৃশংসতার করুণ কথা ও কাহিনী লেখক স্মৃতির দরজা খুলে অত্যন্ত নিপুণভাবে দক্ষতার সাথে সেই বাস্তব ইতিহাস তুলে ধরেছেন। লেখক গ্রন্থ শেষে ‘মেমোরিজ অব এ ওয়ার প্রিজনার’ গ্রন্থের অংশবিশেষ সন্নিবেশনাসহ বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত, দুষ্প্রাপ্য ছবি, গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহে লেখক যে ত্যাগ–তিতিক্ষা ও শ্রমঘাম ঝরিয়েছেন এবং নিপুণভাবে বিভিন্ন তথ্যাদি তুলে ধরেছেন তা প্রশংসনীয়। গ্রন্থটি পুলিশ বিভাগ তথা সারদার মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাস হিসেবে চিরভাস্মর ও চির জাগরুক থাকবে। জাতীয়ভাবে তাঁর জীবন ও সাধনার মূল্যায়নের জন্য জোর দাবি জানাই।
এই কীর্তিমান, মেধাবী ও নিবেদিত প্রাণ লেখক করোনাকালে ৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি বারবার প্রণতি জানাই।
লেখক : অধ্যক্ষ (অব.), শাহ মখ্দুম ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী।