বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে তার শ্রমশক্তির উপর নির্ভরশীল। বলা বাহুল্য এদেশের পোশাক এবং টেক্সটাইল শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের শ্রমের উপর ভর করেই গঠিত হয় এদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং জিডিপি। তথাপি এদেশের শ্রমিকেরা বরাবরই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসাবেই বিবেচিত হয় এবং বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে তাদের অধিকার বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যায়। একটি ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই অর্থনীতি তৈরি করতে সরকারকে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যা শ্রমিকদের অধিকার এবং মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দেয়। এদেশের শ্রম আইন শ্রমিক বান্ধব কিনা তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
আগামী বাজেটে যে বিষয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ তারমধ্যে অন্যতম হলো শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত জাতীয় নিম্নতম মজুরি ঘোষিত হয়নি। ষাটের অধিক সেক্টর থাকলেও মাত্র ৪২টি খাতে নিম্নতম মজুরি ঘোষিত হয়েছে। আবার ঘোষিত নিম্নতম মজুরিও অধিকাংশ সেক্টরে অকার্যকর। জাহাজ ভাঙা শিল্পে ২০১৮ সালে নিম্নতম মজুরি মাসিক ১৬ হাজার টাকা ঘোষিত হলেও অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি। বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা খাতে কোনো নিম্নতম মজুরিই নেই। এই সেক্টরে আয়া মাসিরা চাকরি করে মাসিক ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা মজুরিতে, বাকীরা যা পায়, বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে তা দিয়ে জীবন ধারণ করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালে পোশাক শিল্প খাতের শ্রমিকেরা মাসিক নিম্নতম ২৩ হাজার টাকা দাবি করেছিল অথচ তাদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ৫ শত টাকা। আরো দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ঘোষিত নিম্নতম মজুরিও এখনো শতভাগ পোশাক কারখানায় বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ শ্রমজীবী এবং প্রান্তিক মানুষের ন্যূনতম মানসম্মত জীবন যাপন নিশ্চিত করতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জাতীয় নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করা হয়ে থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে পর্যাপ্ত মজুরি শুধুমাত্র শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে না বরং উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখে।
ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি শ্রম আইন ও বিধিমালা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠন সমূহের পক্ষ থেকে শ্রম আইন ও বিধিমালার বিষয়ে নানা ত্রুটি বিচ্যুতির সমালোচনা রয়েছে। আবার এই ত্রুটিপূর্ণ আইন ও বিধিমালা যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যাপারেও রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। উল্লেখ্য যে, আইন বাস্তবায়নে মালিক পক্ষের অনীহা আর রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠান সমূহের নিস্ক্রিয়তা ও অদক্ষতা প্রধান অন্তরায় বলেই প্রতীয়মান হয়। ফলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকেরা তার ন্যায় সঙ্গত প্রাপ্য অধিকার তথা জীবন ধারণ উপযোগী মজুরি, সচেতন ছুটি, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ, স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার ও দরকষাকষির অধিকার থেকে দীর্ঘকাল যাবত বঞ্চিত রয়ে গেছে। এই অবস্থার পরিবর্তনে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সুরক্ষায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিদর্শন ও তদারকি ব্যবস্থা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক শ্রমমানের সাথে সংগতি বজায় রেখে দেশে মানসম্মত শ্রমমান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।
উপরন্তু বাজেটে শ্রমিকের নিরাপদ কর্মস্থল ও পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বরাদ্দ থাকতে হবে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধস, তাজরীন ফ্যাশনে আগুন, নারায়ণগঞ্জের রূপপুরে সেজান জুস কারখানায় আগুন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বি এম ডিপোতে আগুন, সীমা অক্সিজেন প্লান্টে আগুনে ব্যাপক শ্রমিক আহত ও নিহত হওয়ায় এদেশের কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতির বিষয়টি বারবার উন্মোচিত হয়েছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজও আমরা শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে চরম অনিরাপদ কর্মক্ষেত্র বজায় রেখে একটা দেশের শিল্প এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ফলে দেশের শিল্প এবং অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে দেশের সকল কর্মক্ষেত্রে একটি নিরাপত্তা মান নির্ধারণ হওয়া জরুরি। সরকারের উচিৎ, কারখানা পরিদর্শন, শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রশিক্ষণ কর্মসূচী এবং দুর্ঘটনা রোধ ও শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় নিরাপত্তা প্রটৌকল বাস্তবায়নের জন্য তহবিল বরাদ্দ করা। তদুপরি, বাজেটে শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করা উচিৎ। বাংলাদেশের অনেক শ্রমিকের অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক সুরক্ষা পরিষেবা যেমন স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও আবাসন সুবিধা নেই। সামাজিক সুরক্ষা স্কিমগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মৌলিক পরিষেবা সমূহের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে এবং তারা যাতে অর্থনৈতিক সংকট থেকে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখতে পারে তার জন্য আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে প্রচার, দর কষাকষির অধিকার বাস্তবায়ন শ্রমিক বান্ধব বাজেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার এবং অবাধে দর কষাকষি করার অধিকার থাকা উচিৎ। বাজেটে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচীর জন্য তহবিল বরাদ্দ করা উচিৎ। ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনের লক্ষে প্রয়োজনে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ থাকা উচিৎ। একই যাথে সংকট নিরসনে মালিক–শ্রমিক পরস্পরের মধ্যে আলাপ–আলোচনা এবং সামাজিক সংলাপকে উৎসাহিত করে এমন একটি উদ্যোগকে সমর্থন করা উচিৎ।
শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক চাহিদার পাশাপাশি বাজেটে দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের উপরও জোর দিতে হবে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে বিনিয়োগ করা হলে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং একই সাথে শ্রমিকদের মধ্য হতে উদ্যোক্তা তৈরি করার উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হলে নতুন কর্ম সংস্থানও তৈরি হবে যা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।
অধিকন্তু, সরকারকে লিঙ্গ সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে নারী শ্রমিকরা যেন মজুরি, কাজের অবস্থা বা অগ্রগতির সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার না হয়। শিশু যত্ন সুবিধা এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য সহায়তা প্রদান, নারী শ্রমিকদের তাদের কাজ এবং পারিবারিক দায়িত্বগুলি কার্যকরভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করতে পারে।
উপসংহারে বলা যায়, আসন্ন বাজেট বাংলাদেশ সরকারের শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণের প্রতি অঙ্গীকার প্রদর্শনের একটা সুযোগ তৈরি করেছে। শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা এবং শ্রম অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার আরো একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনীতি তৈরি করতে পারে যা দেশের সকল নাগরিকের হৃদয়ে নতুন প্রত্যাশা জাগাতে সক্ষম হবে।
লেখক: কো–অর্ডিনেটর, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্র, বিলস–ডিটিডিএ প্রকল্প।