M.T. Esperanza – এম.টি. মানে মোটর ট্যাঙ্কার– তেলবাহী জাহাজ। স্প্যানিশে এস্পেরেঞ্জা মানে Hope, আশা। ক্যারিবিয়ানের মাঝে অপূর্ব সুন্দর তিনটা দ্বীপ ABC (Aruba, Bonaire এবং Curaçao); বাংলাদেশ থেকে অনেক ঘুরে সেই কুরাসাও–তে এলাম। দুইদিন সেখানে হাফ–ট্যুরিস্ট হিসাবে কাটিয়ে পাশের দ্বীপ বোনেইর–এ গিয়ে এই জাহাজে উঠলাম। সিঙ্গাপুরে রেজিস্টার্ড করা জাহাজ, কিন্তু বছরের পর বছর ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোতেই তেল বয়ে বয়ে বেড়ায়। হয়তোবা জীবনে কখনই সিঙ্গাপুরে পা–ই দেয়নাই (থুক্কু, জাহাজের ক্ষেত্রে বলতে হবে– সিঙ্গাপুরের পানিতে তার তলদেশ হয়তোবা কখনই ভিজে নাই)। জাহাজের জীবন যে কত আন্তর্জাতিক সেটা বলি–জাহাজের মালিক হংকং–এর Wallem Ship Management Ltd. কোম্পানি; জাহাজটা রেজিস্টার্ড সিঙ্গাপুরে; আর নিয়মিত চলাচল করে ভেনিজুয়েলা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। অফিসাররা ভারতীয়, পাকিস্তানি, ফিলিপিনো, বার্মিজ এবং আমি বাংলাদেশী। অধিকাংশ ক্রু–ই ফিলিপিনো; অল্প কিছু ভারতীয়। আর কার তেল কোন্খান থেকে নিয়ে কার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি, সেটার ফিরিস্তি দিতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলবেন; সেদিকে আর নাই–ই গেলাম। প্রথমে যে বলেছি মালিক হংকং–এর কোম্পানি ওয়ালেম–সেটাতেও একটা বড় ত্রুটি আছে। আসল মালিক কে বা কোন্ দেশের সেটা আমরাও জানি না; সে ব্যক্তি জাহাজ কিনে ওয়ালেম কোম্পানিকে এটা চালনার দায়–দায়িত্ব, ম্যানেজমেন্ট দিয়েছে। ওয়ালেমই জাহাজের ক্রু–অফিসার নিয়োগ করে, খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে তাবৎ কিছু। তারপরে কার্গো বা চার্টারার জোগাড়, জাহাজের মেইন্ট্যানেন্স–রিপেয়ার, সাপ্লাই ইত্যাদি যা যা দরকার সব করে। শিপ–ম্যানেজমেন্ট বা ফ্লিট–ম্যানেজমেন্ট একটা বড়সড় সাবজেক্ট এবং স্বাভাবিকভাবেই বোরিং। তাই চলুন, সেটা বাদ দিয়ে আমার পরবর্তী ছয়–সাত মাসের আশা–ভরসাস্থল সেই এস্পেরেঞ্জাতে ফিরে আসি। (মনে আবারো প্রশ্ন জাগে, জলে ভাসমান জাহাজকে কি ভরসাস্থল বলা যাবে? না ভরসাজল বলবো)?
মাস তিন–চারেক আগে ওয়ালেম কোম্পানিরই আরেকটা ট্যাঙ্কারে (M.T. Jahre Prince)-এ থাকা অবস্থায় আমি গুরুতরভাবে গরম তেলে পুড়ে গিয়ে মাসখানেক অ্যামেরিকার হাসপাতালে কাটিয়ে, এখন সুস্থ হয়ে, আবার সমুদ্রে ফিরলাম থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। ১৯৯১–এর জানুয়ারিতে জয়েন এবং সে বছরই আগস্টে কন্ট্রাক্ট শেষে বাসায় ফিরেছিলাম। জাহাজটা ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি PDVSA (Petróleos de Venezuela, S.A. – স্থানীয়রা স্প্যানিশ ভাষায় PDVSA–কে উচ্চারণ করে– পেদেভেসা) চার্টার বা ভাড়া করে নিয়েছে। আমরা যেরকম পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, বা পিএলসি (Plc), এললসি (LLC) ইত্যাদি ব্যবহার করি; অনেক দেশের বিজনেসেই কোম্পানিগুলো ফ্রেঞ্চ ভাষায় Société Anonyme (S.A.) ব্যবহার করে থাকে। PDVSA–র তেল বহনের জন্যেই বছরের পর বছর জাহাজটা এই অঞ্চলে রয়ে গেছে। আমরা বড় জাহাজ বা টার্মিনাল থেকে তেল নিয়ে রিফাইনারিগুলোতে সাপ্লাই দেই। এর ফলে আমাদেরকে ভেনিজুয়েলার অনেক অনেক পোর্টেই শাটলের মত চলাচল করতে হতো; আবার মাঝে মাঝেই ভেনিজুয়েলার উত্তরের সেই স্বপ্নের দ্বীপ তিনটা (আরুবা,বোনেইর ও কুরাসাও)-তেও যেতাম। ভেনিজুয়েলার পুয়ের্তো লা–ক্রুজ (Peurto La Cruz) আমাদের হোমপোর্ট; কারণ এখানেই সবচাইতে বেশী আসতাম। এছাড়াও, এল পালিতো (El Palito), পুয়ের্তো কাবেইয়ো (Puerto Cabello), মারাকাইবো (Maracaibo), লা সালিনা (La Salina) এরকম অনেক অনেক পোর্টে বা PDVSA–র টার্মিনালে গিয়েছি। এস্পেরেঞ্জাতে থাকা অবস্থায় দিনের পরে দিন সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লম্বা ভয়েজ করতে হয়নাই। প্রায় সময়ই এক পোর্ট থেকে পরের পোর্টে যেতে লাগতো কয়েক ঘন্টা বা সর্বোচ্চ একদিন কী দুইদিন। তিন–চারদিনের ভয়েজ হলে মনে হতো অনেক দূরে কোথায়ও চলে এলাম। অথচ আমরা মেরিনাররা দিনের পর দিন খোলা সমুদ্রেই ভাসতে অভ্যস্থ; আমি তো বাইশ দিন থেকে শুরু করে পঁচিশ দিন অবধি লম্বা ভয়েজ করেছি– এক পোর্ট থেকে পরবর্তী পোর্টে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের যত দেশে গিয়েছি, সব দেশই ভালো লাগে। ভেনিজুয়েলাও এর ব্যতিক্রম নয়– এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মোহনীয়, ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদও প্রচুর। এদের আছে প্রচুর তেল– সেজন্যই ভেনিজুয়েলা ওপেক–এর একটা বড় সদস্য। এদের পরামর্শেই ১৯৬০ সালে প্রথম ওপেক–এর মিটিং হয়; এরা ওপেকের একজন ফাউন্ডিং মেম্বার। এত দামী সম্পদ থাকার পরেও নিজেদের দুর্নীতি ও সেইসঙ্গে বিশ্বরাজনীতির চক্করে পড়ে দেশটা হতদরিদ্র দেশগুলোর একটা। এস্পেরেঞ্জাতে পুরা সাতমাসই ভেনিজুয়েলাতে কাটিয়েছিলাম; আবারো, পরবর্তীতে মেরিন লাইফের পাট চুকিয়ে যখন অ্যামেরিকায় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ইন্ড্রাস্টিতে কাজ করেছি, তখনো দু–তিনবার গিয়েছি– সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু সবসময়ই দেশটাকে ভাল লেগেছে।
দেশটার এতই তেল সম্পদ রয়েছে যে, আমাদের কাছে মাঝে মাঝে মনে হতো পানির চেয়ে পেট্রোলের দাম অনেক অনেক কম। অবশ্যই সরকার আভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্যে তেলকে অনেক বেশি সাবসিডাইজ্ড্ করে, আর্টিফিসিয়ালি দাম কম রেখেছিলো। ১৯৫০–৬০ এর দশকে যখন এরা তেলের অর্থনীতিতে ঢুকলো, তখন হঠাৎ করে সেই দেশের উপর অনেক ধরনের প্রভাব পড়েছিলো; যার অধিকাংশই ছিলো ক্ষতিকর। সরকারের অনেকেই তেলের টাকায় দুর্নীতিতে ডুবে গেলো, দেশের প্রকৃত উন্নতি কেউই দেখলো না। অথচ অন্যদিকে অধিকাংশ জনসাধারণই দরিদ্র রয়ে গেলো, বা দিনে দিনে আরো দরিদ্র হলো। দেশের তৎকালীন তেলমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলো “তেল মানে কালো–সোনা নয়, এটা হচ্ছে শয়তানের মল” (Oil was not black-gold; it is the devil’s excrement – Juan Pablo Pérez Alfonzo)।
মল হোক, সোনা হোক, আমরা সেটাই জাহাজে বয়ে নিয়ে বেড়াতাম। জাহাজের ব্যাপারী আমরা, মলের খবর নিয়ে কী করবো? তবে, সেই ১৯৯১ সালেই সাধারণ জনগণের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ দেখতাম, বুঝতাম। তারপরেও দিন চলতো তাদের। যেহেতু আমরা সবসময় সামুদ্রিক পোর্টে থামতাম, সেজন্যে সবগুলোতেই সি–বীচ দেখতাম। সেখানে মানুষজন সবসময় আমোদ–প্রমোদে মত্ত। আমাদের পকেটে অ্যামেরিকান ডলার, তাই দোকানপাট, শপিং–মলে আমাদের খুবই কদর ছিলো। আমরা সারাদিনের কাজ শেষ করে, বিকালে সি–বীচের পাশের রেস্টুরেন্টে ডিনার করতাম। প্রতিদিন জাহাজের কুকের রান্না খেতে ভালো লাগতো না। খাবারে একটু বৈচিত্র্য, নতুন কিছু মানুষ দেখা– এগুলোর তাগিদেই বের হয়ে যেতাম শোর–লীভে (shore leave)।
দক্ষিণ অ্যামেরিকার অধিকাংশ দেশগুলোর মতই, এরাও দু–তিনশ’বছর স্প্যানিশ কলোনি ছিলো; ফলে তাদের সকলের ভাষাই স্প্যানিশ; এবং কৃষ্টি–সংস্কৃতি সেরকমই। ল্যাটিন অ্যামেরিকান দেশগুলোর মানুষেরা অনেক জাতের মিশ্রণ– আদিবাসী ইনকা, এজটেক, রেড ইন্ডিয়ান সকলের রক্ত, ইউরোপিয়ান রক্ত আর যুক্ত হয়েছে অনেক ক্রিতদাস আফ্রিকানদের রক্ত। সব মিলিয়ে একাকার। তবে অন্যান্য সবগুলো দেশের তুলনায় আমি দেখলাম ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর ভেনেজুয়েলার মানুষেরা অনেক অনেক সুন্দর। ইউরোপিয়ানদের মত ফ্যাকাসে ফর্সা নয়, আদিবাসীদের মতো তামাটে নয় আবার আফ্রিকানদের মত কালোও নয়– সবকিছুর মিলনে এক অপূর্ব সুন্দর রং এবং দেহসৌষ্ঠব তাদের।
আমি ১৯৯১–এর আগস্টে দেশে ফিরে আসার বছরখানেক পরেই সে দেশের প্রেসিডেন্ট দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ভেনিজুয়েলা সেই ১৮১১ সালেই স্বাধীনতা পেলেও, রাজনৈতিকভাবে কখনই স্থিতিশীল হতে পারে নাই। ক্ষমতা দখলের জন্যে হানাহানি, অভ্যুত্থান, হত্যা চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। তার উপরে, দেশটা আবার একটু কমিউনিস্ট– ঘেঁষা, সমাজতান্ত্রিক; রাশিয়া–কিউবার সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক ভালো। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ব–মোড়ল দেশ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে খুব একটা সুসম্পর্ক নাই। মাঝে মাঝেই সেটা তুঙ্গে উঠে। অথচ সেই অ্যামেরিকা কিন্তু ভেনিজুয়ালার থেকে প্রচুর তেল কিনে। বিশ্ব–রাজনীতি বোঝা কঠিনই বটে। তবে সমপ্রতি সেদেশের খবর দেখে মন খুব খারাপ হয়ে যায়, অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অরাজকতা; পেটের দায়ে দেশ ছেড়ে মানুষজন পালিয়ে যাচ্ছে– এগুলো শুনলে খুব খারাপ লাগে; আর আমার চোখে ভাসে আমার দেখা সুন্দর একটা দেশে, সুন্দর মানুষদের সুন্দর জীবন–যাপনের চিত্র। মনে হয় ষাটের দশকে তাদের মন্ত্রী ঠিকই বলেছিলেন–দেশটা আসলে কালোসোনার উপরে নয়, শয়তানের মলের উপরে ভাসছে!
আগস্টে আমার দেশে ফেরার সময় ঘনাচ্ছে, এসময় জাহাজ পুয়ের্তো–রিকোর রাজধানী স্যান হুয়ান (San Juan) চললো। এটা সুখবরই বটে। পুয়ের্তো–রিকো দ্বীপটা অ্যামেরিকার কোনো রাষ্ট্র না হলেও; এটাকে টেরিটোরি হিসাবে গণ্য করা হয়– মানে এখানে সব অ্যামেরিকান। আমার মাথায় একটা সুন্দর প্ল্যান চলে এলো। বেলায় বেলায় তো বয়স বেড়েই চলেছে; বড় পাঁচ ভাইয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে; বাসা থেকে আমার উপরে চাপ বাড়ছে। তাই, স্যান–হুয়ানে সব বড় বড় দামী অ্যামেরিকান ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, Macys, JcPenny থেকে একগাদা কসমেটিক্স্ ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে ফেললাম। সেল্স্পার্সনরা সেদিন অনেক বিক্রি করতে পেরে খুব খুশী। এতই কেনাকাটা করেছিলাম যে, তারা ফ্রি গিফ্ট্ দিতে দিতে শেষ। আমার জন্যে সেগুলোও বিয়ের বাজারের আইটেম হয়ে গেলো। এরপরে, স্যান–হুয়ান থেকে ফ্লোরিডার মায়ামি হয়ে লন্ডন, তারপরে বাংলাদেশে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম। সত্যি সত্যিই সেবারে ঘরে ফেরার কিছুদিনের মাথায় আমাদের এনে্গজমেন্ট হয়ে গেলো ১৯৯১–এর ১০ অক্টোবরে।
রিনো ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া ২০২৪