আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম রমজানের তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ নামাজ

ফখরুল ইসলাম নোমানী | বুধবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

রমজানে মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি উপহার তারাবি নামাজ। রমজানের শুরুতেই শহরে কিংবা গ্রামে সর্বত্র মোমিন মুসলমানদের উপচেপড়া ভিড়ে মসজিদগুলো কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে। এতদিন নামাজের প্রতি যাদের অবহেলা ছিল তারাও মসজিদমুখী হয়। দুপুরের পর থেকে রোজাদাররা যখন মসজিদ চত্বরে ক্লান্তভাবে বসে বসে তসবিহতেলাওয়াতে নিমগ্ন হয়, দেখে মনে হয় তারা পরম শান্তির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। আল্লাহর রহমতের কাছে আশ্রয় চেয়েছে। আল্লাহর সান্নিধ্যের ছোঁয়া পেয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ)-থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি রামাদান মাসে ঈমানের সাথে ও একান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যের নিমিত্তে তারাবীহ পড়ে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। নিশ্চয় আল্লাহতাআলা তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য তারাবিহ নামাজকে সুন্নাত করেছি। রামাদান মাসে বিশেষ এক ধরনের সালাতপড়া হয় যাকে সালাতুত তারাবীহ বা তারাবীহর সালাত বলা হয়। এ সালাত খুবই গুরুত্বের সাথে আদায় করা হয়। এমনকি যারা ফরয সালাত নিয়মিত আদায় করে না তারাও তারাবীহর সালাত আদায় করে।

কোরআন নাজিলের মাস রমজান। তারাবীহর নামাজের প্রধান উদ্দেশ্য কোরআন তেলাওয়াত করা ও শোনা। এ নামাজেই মাসব্যাপী পূর্ণ কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করা হয়। একে খতম তারাবিহ বলে। আবার ছোট ছোট সুরা দিয়েও তারাবিহ নামাজ পড়া যায়। অনেকে এটাকে সুরা তারাবিহ বলে থাকে। রমজান মাসের প্রতিটি দিবস যেমনি ধর্মীয় উপলক্ষ্য তেমনিভাবে রাত্রিবেলাও রোজাদারের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দিনের বেলায় সিয়াম সাধনা আর রাত্রিকালীন নফল নামাজের মাধ্যমে রোজাদার আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হয়। হাদীস শরীফে এসেছে ‘মান ক্বামা রমজানান ঈমানান ওয়া ইহতিছাবান গুফিরা লাহু মা তাকাদ্দামা মিন জনবিহি’ অর্থাৎ, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিছাবের সাথে রমজানে নামাজ আদায় করবে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।-(মেশকাত শরীফ) তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ নামাজ যদিও ফরজ নয় তবু এ নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সীমাহীন। বান্দা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাহাজ্জুদের বিকল্প নেই। মাহে রমজানে যেহেতু প্রতিটি নফলের জন্য ফরজের সাওয়াব দেয়া হয় সেহেতু এই সময়ে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ অত্যন্ত ফজিলত সমৃদ্ধ ইবাদত।

তারাবীহ নামাজ হানাফি মাযহাব অনুযায়ী বিশ রাকাআত পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ছহীহ মুসলিম শরীফ থেকে জানা যায় রাসুল (সা.)-রমজান মাসে নিজে তারাবীহ পড়েছেন এবং এ নামাজ আদায়ে সাহাবীদেরকে বিশেষভাবে ঊৎসাহ দিয়েছেন। তবে এটি ফরজ হিসেবে নয়। তারাবীহ নামাজ পুরুষেরা মসজিদে জামায়াত সহকারে পড়তে পারে। চাইলে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মহিলারাও মসজিদের জামায়াতে হাজির হতে পারে। তবে মহিলাদের বিনা জামায়াতে ঘরে পড়াই উত্তম। সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করা সুন্নাতে রাসূল। সালাতুত তাহাজ্জুদ অত্যন্ত বরকত ও ফজিলতপূর্ণ সালাত। এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন এবং নৈকট্য লাভ করতে পারে। রমজান মাসে পুরুষদেরকে বিতরের নামাজ তারাবীহর সাথে জামায়াতে পড়তে হয়। পুরো রমজানে তারাবীহর মধ্যে কুরআনুল কারীম খতম করা সুন্নাত। তবে অবশ্যই এটি হতে হবে ধীরেসুস্থে, অর্থ ও ভাব বুঝার আগ্রহ নিয়ে। তাড়াহুড়া করে যেনতেন ভাবে খতমে তারাবীহ পড়ার কোনো মূল্য নেই। ৭ দিনে কিংবা ১০ দিনে তাড়াহুড়া করে খতমে তারাবীহ সম্পন্ন করার প্রয়াস ফলপ্রসূ নয়। ফরজ নামাজের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। আল্লাহর রাব্বুল ইজ্জাত প্রিয় নবীজি (সা.)-কে লক্ষ্য করে কোরআন কারিমে বলেন, ‘এবং রাত্রির কিছু অংশ তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করো ইহা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানেমাকামে মাহমুদে’ (সুরা১৭ ইসরা,আয়াত : ৭৯)। রহমতের শ্রেষ্ঠ মাস রমজান। রহমতের শ্রেষ্ঠ সময় তাহাজ্জুদের সময়। শবে কদরসহ বছরের বিশেষ রাতগুলোতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহতাআলা দুনিয়ার নিকটতম আসমানে অবতরণ করেন। তাহাজ্জুদের সময়ে প্রতি রাতেই আল্লাহতাআলা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদের আরজি ও আবেদননিবেদন শোনেন। রমজান মাসে ফরজ রোজা পালনের জন্য সাহ্‌রি খাওয়ার সুন্নত আদায়ের জন্য উঠতে হয় এবং সাহ্‌রির সময়ই হলো তাহাজ্জুদের সময়। সুতরাং রমজানে তাহাজ্জুদ আদায় করা খুবই সহজ। তাহাজ্জুদ ২ রাকাত করে ৮ রাকাত, ১২ রাকাত বা আরও কম বা বেশিও পড়া যায়। রমজানের নফলের সওয়াব ফরজের সমান ফরজের সওয়াব ৭০ গুণ। তাই রমজানে তাহাজ্জুদের সহজ ও সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। রমজানে মহানবী (সা.)-নিজেও রাতের শেষ প্রহরে জাগতেন এবং পরিবারের সবাইকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জাগিয়ে দিতেন। আমাদেরও রমজানে সাহ্‌রি খাওয়ার আগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত।

সারাদিন উপবাস থেকে সন্ধ্যায় ইফতার ও মাগরিব নামাজের পর এশার আজান হয় ক্লান্ত শরীরের সব জড়তা ঝেড়ে রোজাদার জামাতে শামিল হয়। অন্য সময় এশার সুন্নত নফল কম পড়ার প্রবণতা থাকলেও রমজানে এক অদম্য প্রেরণায় উজ্জীবিত থাকে সবাই। দীর্ঘ দেড় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোরআন খতমে শরিক হয়। সারা দিন মান সিয়াম সাধনায় শরীরের ক্লান্তি ও ভার নামিয়ে রেখে রাতে আত্মিক ভাবরসে সিক্ত মনে আল্লাহর কালাম শোনে পবিত্র অবস্থায়। এইদৃশ্য এই অভিজ্ঞতার মহিমা বর্ণনা কোনো কলমের দ্বারা সম্ভব নয়। এ জন্যই হাদিস শরিফে নবী করিম (সা.)-এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব সহকারে রাত জেগে ইবাদত করবে (সব মুহাদ্দিসের অভিন্ন মত হলোরাত জেগে ইবাদত মানে রমজানের বিশেষ আয়োজন তারাবি নামাজ) তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। ইহতিসাব মানে আত্মচেতনা আত্মসমালোচনা জাগ্রত মনে সওয়াবের প্রেরণা। তারাবি নামাজের প্রধান অনুষঙ্গ খতমে কোরআন। অর্থাৎ ৩০ পারা কোরআন মজিদ রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবিহ নামাজে একবার তেলাওয়াত করা। হাফেজ সাহেবরা নামাজে তেলাওয়াত করেন আর বিশুদ্ধ উচ্চারণের এই তেলাওয়াতে প্রাণ জুড়ানোর ব্যবস্থা থাকে মুসল্লিদের জন্য।

মাহে রমজান বান্দার জন্য শ্রেষ্ঠ একটি মাস। এই মাসের ইবাদতবন্দেগির সাওয়াব অন্য যেকোনো মাসের চেয়ে বহুগুণ বেশি। রমজানে নফল সালাত আদায় করলে অন্য মাসের ফরজের সমতুল্য সাওয়াব পাওয়া যায়। আর রমজান মাসে রোজাদাররা যেহেতু সাহরি গ্রহণ করার জন্য ওঠেন একটু আগেভাগেই উঠে এই ফজিলতপূর্ণ সালাত আদায় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ক্ষমা প্রার্থনার সুবর্ণ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে অশেষ কল্যাণ লাভ করতে পারেন। তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ রোজাদারকে মাগফিরাতের মনজিলে নিয়ে যায়।

আসুন, আমরা রমজান মাসে ফরজ আদায়ের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল নামাজ ও যিকরআযকারের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য এবং অত্যধিক ফয়জবরকত হাছিল করি। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিতিনি আমাদেরকে হেদায়েতের সরল পথে পরিচালিত করুন। আমাদেরকে খাঁটি মুমিন হওয়ার তওফিক দিন। আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে আমি আরেকবার মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি। প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পরিবারসহচরবৃন্দের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশৈশব হলো বড় পাঠশালা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে