‘শহীদ রুমি স্কোয়াড’ এর যাত্রা শুরু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একশ সাতাশতম প্রয়াণ দিবসে। পরাধীন বাংলার পুনর্জাগরণের পথিকৃত, বাঙালির অগ্রযাত্রার ইতিহাসের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ বিদ্যাসাগরের তিরোধানের প্রায় আট দশক পর দেশমাতার মুক্তির প্রত্যয় নিয়ে প্রাণ উৎসর্গকারী যুবক রুমিকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলে শহীদ রুমি স্কোয়াড। হাঁটি হাঁটি পা পা করে তিনটি বছর পাড়ি দিলেও আমাদের নাগরিক সমাজের অনেকেই জানে না ‘শহীদ রুমি স্কোয়াড’ কি, এই সংগঠনটির কাজই বা কি। প্রকৃতপক্ষে এটিকে সংগঠন না বলে প্রতিষ্ঠান বলা চলে, যেখানে অক্ষরশিক্ষা ও পাঠদানই মুখ্য নয়, বরং সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ক্ষুদে শিক্ষার্থী, এমনকি তাদের অভিভাবকদেরকে।
শ্রমজীবী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সুস্থ জীবনবোধ জাগ্রত করার জন্য কাজ করছে ‘শহীদ রুমি স্কোয়াড’। সমাজের নিচের তলায় বসবাসকারী হতদরিদ্র, অবহেলিত পরিবারের সন্তানদের মাঝে শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে প্রাণশক্তিতে ভরপুর নিবেদিতপ্রাণ কিছু তরুণ কাজ শুরু করেন নিতান্ত পরীক্ষামূলকভাবে। ‘নতুন মানুষ নতুন সমাজ’ -এই মূলমন্ত্রকে বুকে লালন করে চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের পরিত্যক্ত কিছু লাল বগির আশেপাশে গড়ে ওঠা বস্তিতেই শুরু হয় এর কার্যক্রম। গৃহকর্মী, রিকশা ও সিএনজি চালক, পোশাকশ্রমিক, অন্যান্য কলকারখানার শ্রমিকসহ নানান ছোটখাট পেশাজীবীদের বসবাস এই বস্তিতে। বাংলাদেশের নাগরিক হলেও নাগরিক সুবিধার তেমন কিছুই তাঁদের জোটে না, যদিও রাষ্ট্রের উন্নয়নে তাঁরা প্রতিনিয়ত শ্রম ঘাম রক্ত ও প্রাণ দিয়ে যান। তাঁদের সন্তানরা পড়বে, লিখবে, ছবি আঁকবে, গান গাইবে, নাটক করবে – এসব কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেননি জীবনযুদ্ধে পরিশ্রান্ত এইসব ভাসমান শ্রমজীবিরা। এই মানুষদের ঘুনে ধরা জীবনে নতুন প্রাণ আর গতি এনে দিয়েছে শহীদ রুমি স্কোয়াড।
শহীদ রুমি স্কোয়াডে সকাল হয় এক ঝাঁক শিশু কিশোরের কোলাহলে। বাঁশের বেড়া, টিনের ছাউনি, মাটির মেঝেতে ত্রিপলের আচ্ছাদন- অবকাঠামো বলতে এই-ই। ভেতরে যেন যাদুর খেলা, এক স্বপ্নকুটির। সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া চার দেয়াল থেকে শিশুদের দিকে তাকিয়ে আছেন শত মনীষী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরতো আছেনই। রাজা রামমোহন রায়, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্র, নজরুল, রোকেয়া, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, জসিমউদ্দিন, জয়নুল, স্যার জগদীশ চন্দ্র, বেগম সুফিয়া কামাল, বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জননীসহ অনেক বাঙালির পাশেই আছেন গ্যালিলিও, দ্যা ভিঞ্চি, নিউটন, শেঙপিয়ার, মাদাম কুরি, আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা … এমনকি নির্বাক হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিনও। এক দেয়ালে বইয়ের পাহাড়ের পাশ থেকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে উনিশ বছরের টগবগে যুবক শহীদ রুমি। রুমির প্রতিকৃতির নিচে নজরুলের কবিতা- ‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে।’
এ-তো বিদ্যালয় নয়, যেন শিশুস্বর্গ। বস্তির ছেলেমেয়েরা খেয়ে না খেয়ে, প্রতিদিন ঈদের আনন্দ নিয়ে পরিপাটি হয়ে প্রবেশ করে শহীদ রুমি স্কোয়াড এ। পড়া দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যাঁরা ওদের আশেপাশে থাকেন তাঁরা কেউই শিক্ষক বা গুরুজন নন, বন্ধু হয়ে যান ওদের। তোতাপাখির মতো বইয়ের পড়া মুখস্থ করা নয়, যে যার নিজের মতো করে পড়ে। যার খুশি লেখে, কেউবা ছবি আঁকে। ওদের আঁকা ছবি দিয়ে আয়োজন করা হয় চিত্রপ্রদর্শনী। প্রতিদিন ওদেরকে গল্প শোনানো হয়। মনীষীদের জীবনী পাঠের ব্যবস্থা থাকে বিশেষ দিবসে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনীও চলে। সীমিত সাধ্য দিয়েই জাতীয় দিবস উদযাপিত হয় পরম মমতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে। শিশুরা নিজ হাতে নির্মাণ করে শহীদ মিনার। প্রয়োজনে হাত লাগায় মায়েরা।
শিশু শিক্ষার্থী ছাড়াও শহীদ রুমি স্কোয়াডে বিকেলবেলা আসর জমায় পথভোলা কিশোরযুবার দল। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের এঁদো গলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা শিশুকিশোরদেরকে ক্রমাগত হাতছানি দিয়ে ডাকে অন্ধকার জগত। রুমি স্কোয়াডের সৈনিকেরা ওদের ফেরাতে চায়। মমতা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, মর্যাদা দিয়ে ওদের ডেকে নেয় কাছে। ওদের গল্প শুনে। না-বলা কথাগুলো প্রাণখুলে বলতে পেরে আনন্দিত তরুণেরা মেতে ওঠে কর্মে, সৃষ্টিশীলতায়।
এ যেন এক মহা কর্মযজ্ঞ। মূলধারার বিদ্যালয়গুলোতে আজকাল শিক্ষার্থীদের জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকে না বললেই চলে। আমরা উঁচু তলার নাগরিকরা সোনালি জিপিএ-র মোহে আমাদের সন্তানদের কলের পুতুল বানিয়ে রেখেছি। ওদের জীবনের যেমন আনন্দ কেড়ে নিয়েছি, তেমনি বন্ধ করে রেখেছি মূল্যবোধ চর্চার সকল দুয়ার। পরীক্ষায় শতকরা একশ ভাগ নম্বর প্রাপ্তির নিশ্চয়তা অর্জনের লক্ষে আমরা জলের মতো টাকা ঢালছি ওদের পেছনে। সেই অঢেল অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনে অসদুপায় অবলম্বন করতেও প্রাণ কাঁপে না আমাদের। আমরা ছুটে চলেছি মোহগ্রস্তের মতো। গন্তব্য জানা নেই আমাদের।
লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গন্তব্য ঠিক করেই পথে নেমেছে শহীদ রুমি স্কোয়াড। সীমাহীন সংকটের মাঝেও সম্ভাবনা ও প্রত্যাশার আলো দেখে রুমি স্কোয়াডের স্বপ্নচারী তরুণেরা। অন্ধকার গলিতে আলো ফোটানর এই সংগ্রামে ওরা কি একাই লড়ে যাবে, আর আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখব, কিংবা দেখবই না? রাষ্ট্রীয় সুবিধার সবটুকু ভোগ করা নাগরিক সমাজ কি এগিয়ে এসে ওদের পাশে দাঁড়াবে না? ওদের মতো পথে নামতে না পারি, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে না পারি, ওদের সমর্থন ও সহমর্মিতাতোও কি আমরা দেখাব না? বিত্তবান সচেতন নাগরিকগণ এবং সমাজসেবা অধিদপ্তর, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মীবাহিনীর সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া হাজারো ঝঞ্ঝাটে ভরা এই সমাজে রুমি স্কোয়াডের পথচলা নিষ্কণ্টক হবে না। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এর কার্যক্রম ও পরিধি আরও বিস্তীর্ণ করা সম্ভব।
রুমি স্কোয়াড ছড়িয়ে পড়ুক বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, পাড়ায়-পাড়ায়। এই নতুন মানুষদের হাত ধরেই গড়ে উঠবে নতুন সমাজ, যে সমাজে শান্তি নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করবে প্রতিটি নাগরিক, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে। সেদিন খুব দূরে নয়।