আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক টাকা আদায়ে মামলা দায়েরের সময়সীমা প্রসঙ্গে

জিয়া হাবীব আহ্‌সান | সোমবার , ২৬ জুন, ২০২৩ at ৫:১২ পূর্বাহ্ণ

ব্যাংকিং সেক্টরে বিনিয়োগকৃত ঋণের সকল অনিয়মিত দূর করা সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বা বিনিয়োগ আদায় সম্পর্কিত যাবতীয় মামলা অর্থঋণ আদালতে দায়ের করতে হয়। যা উক্ত আদালতেই নিষ্পত্তি হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলতে বুঝায় বিভিন্ন আইনের অধীনে গঠিত সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক, বিভিন্ন ব্যাংকিং কোম্পানি, গৃহ নির্মাণ ঋণ দান কর্পোরেশন, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন, শিল্প ঋণ সংস্থা, শিল্প ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন, ডেভেলভমেন্ট ব্যাংক, কর্পোরেশন ইত্যাদিকে বুঝায়। উল্লেখিত যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ধার, ঋণ, এডভ্যান্স, ওভার ড্রাফট, ক্রেডিট সুবিধা, গ্যারান্টি, ইনডেমনটি, ঋণপত্র এবং এর উপর বৈধভাবে আরোপিত সুদ, দণ্ড সুদ বা মুনাফা, ক্ষতিপূরণ বা ভাড়া ইত্যাদি আদায়ে মামলা উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের পক্ষে সংশ্লিষ্ট অর্থঋণ আদালতেই দায়ের করতে হবে। অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের সম্পর্কে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ধারা ২৭(কক) এর উপধারা (৪) এর দিকে আলোকপাত করা যাক। এখানে বলা আছে, খেলাপী ঋণ গ্রহীতার (Defaulter Borrower) বিরুদ্ধে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রচলিত আইন অনুসারে মামলা দায়ের করবে।

উল্লেখ্য, এখন কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের টাকা আদায়ের জন্য বিশেষ আইন হিসেবে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩্থ কার্যকর রয়েছে এবং এই আইনের অধীনে গঠিত অর্থঋণ আদালতেই মামলা দায়ের করতে হবে। গ্রাহক কর্তৃক ব্যাংকের বিরুদ্ধে অত্র আদালতে কোনো মামলা চলে না। এখানে বিবাদী পক্ষে কাউন্টার ক্লেইম বা পাল্টা দাবী Set Offএর দাবীও উত্থাপন করতে পারবেন না। এজন্যে বিবাদীকে দেওয়ানী আদালতে পৃথক মানী/ ঘোষণার মোকাদ্দমা দায়ের করতে হবে। এখন দেখতে হবে যে, আইনে কখন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ‘খেলাপী ঋণ গ্রহীতা’ বা Defaulter Borrowerবলে বিবেচিত হবে? এ সম্পর্কে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৫ এর (গগ) তে বলা আছে- ‘খেলাপী ঋণ গ্রহীতা’ অর্থাৎ ‘Defaulter Borrower ’ অর্থ এমন কোন দেনাদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী যার নিজের বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত কোন অগ্রীম, ঋণ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা তার উপর অর্জিত সুদ বা মুনাফা মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৬ (ছয়) মাস অতিবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ কোন ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৬ (ছয়) মাস পর সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে ঋণের টাকা আদায়ে মামলা দায়ের করা যাবে, এর আগে নয়। তবে এটা আইনের মেন্ডেটরী প্রশিক্ষণ নয়। ডাইরেক্টিভ প্রবিশন হয় (ধারা ৪৬)। এখন তাহলে প্রশ্ন হলো- ঋণ বলতে কী বুঝায়? এ সম্পর্কে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর ধারা ২ এর (গ) তে বলা আছে ‘ঋণ্থ অর্থ- (১) অগ্রিম, ধার, নগদ ঋণ, ওভার ড্রাফট, ব্যাংকিং ক্রেডিট, বাট্টাকৃত বা ক্রয়কৃত বিল, ইসলামী শরীয়া মোতাবেক পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিনিয়োগকৃত অর্থ বা অন্য যে কোন আর্থিক অনুকূল্য বা সুযোগ-সুবিধা; (২) গ্যারান্টি, ইনডেমনিটি, ঋণপত্র বা অন্য কোন আর্থিক বন্দোবস্ত যা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ গ্রহীতার পক্ষে প্রদান বা জারী করে বা দায় হিসাবে গ্রহণ করে; (৩) কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তার কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে প্রদত্ত কোনো ঋণ; এবং (৪) উপরোল্লিখিত ঋণ বা বিনিয়োগকৃত অর্থ এর উপর বৈধভাবে আরোপিত সুদ, দণ্ড সুদ বা মুনাফা বা ভাড়া। অর্থঋণ আইনের ধারা ৪৭ উল্লেখ করা হয় যে, মূল বিনিয়োগকৃত অর্থের দ্বিগুণ অর্থাৎ তিনগুণের অতিরিক্ত অর্থ দাবী করে কোনো মামলা করা যাবে না। উল্লেখ্য, অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর অধীনে ঋণের দায় আদায়ে অর্থঋণ মামলা দায়ের কখনও তামাদিতে বারিত হয় না। কিন্তু, এই আইনের ৪৬ ধারায় বর্ণিত মেয়াদের মধ্যে ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা না হলে আদালত বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীকে লিখিতভাবে অবহিত করবেন। আর কোনো কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে উক্ত মেয়াদের মধ্যে মামলা দায়ের করা না হলে, প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী তা অবহিত হবার ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকার এবং আদালতকে অবহিত করবেন৷

অর্থঋণ আইন ২০০৩ সালের বিধান ব্যতিরেকে, কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন কোনো কার্যধারা বা এর কোনো আদেশ, রায় বা ডিক্রীর বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিবাদীর নিকট হতে কোনো স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে বা অস্থাবর সম্পত্তি দায়বদ্ধ রেখে ঋণ প্রদান করলে এবং বন্ধক প্রদান বা দায়বদ্ধ রাখার সময় বন্ধকী বা দায়বদ্ধ সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষমতা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করা হয়ে থাকলে, তা বিক্রয় না করে এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থঋণ পরিশোধ বাবদ সমন্বয় না করে, অথবা বিক্রয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ না হয়ে, সরাসরি অর্থঋণ আদালতে কোনো মামলা দায়ের করা যাবে না। প্রশিক্ষণেরে বিকল্প নেই। প্রত্যেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ-ব্যাপারে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্মান ও সম্পর্ক
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়