ঋণ খেলাপিদের আরেক দফা সুবিধা দিল সরকার; ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে না। করোনাভাইরাসের কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঋণ শ্রেণিকরণে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মহামারীর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় গত ১৫ জুন আরও তিন মাস বর্ধিত করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল।
সেই সময় আরও তিন মাস বাড়িয়ে গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারি করে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ঋণ খেলাপিদের তৃতীয় দফা সময় দেওয়ার সিদ্ধান্তে হতাশা ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। খবর বিডিনিউজের। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কি আর বলবো…! কি হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে? কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি করছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ব্যাংকিং খাতে যে এক ধরনের অরাজকতা চলছে, এটা তারই নিদর্শন। এমনিতেই আমাদের ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো না। এরপর একটার পর একটা এ ধরনের অযৌক্তিক সুযোগ–সুবিধা দিয়ে ব্যাংকিং খাত তথা আর্থিক খাতকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় গত ১৯ মার্চ এক সার্কুলারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, ১ জানুয়ারি ২০২০ ঋণের শ্রেণিমান যা ছিল, আগামী ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ওই ঋণ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না।
পরে ১৫ জুন এ সংক্রান্ত অপর একটি সার্কুলারে বলা হয়, ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ঋণ/বিনিয়োগের শ্রেণিমান যা ছিল, আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ওই ঋণ/বিনিয়োগ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। তবে কোনো ঋণের/বিনিয়োগের শ্রেণিমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে।
সর্বশেষ সোমবারের নির্দেশনায় বলা হয়, কোভিড–১৯ মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা থাকায় অনেক শিল্প, সেবা ও ব্যবসা খাত তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। তাই ১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে ঋণ/বিনিয়োগের শ্রেণিমান যা ছিল, আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ওই ঋণ/বিনিয়োগ তার চেয়ে বিরূপমানে শ্রেণিকরণ করা যাবে না। তবে কোনো ঋণের/বিনিয়োগের শ্রেণিমানের উন্নতি হলে তা যথাযথ নিয়মে শ্রেণিকরণ করা যাবে।
সোমবারের সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, কোভিড–১৯ মহামারীর কারণে অর্থনীতির অধিকাংশ খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা থাকায় অনেক শিল্প, সেবা ও ব্যবসা খাত তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।
এ ব্যাপারে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। সরকার ঋণ খেলাপিদের একটার পর একটা সুবিধা দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অবস্থা যে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, সে দিকে কোনো নজর নেই। হাতেগোনা চিহ্নিত কয়েকজন লোককে সুযোগ দিতে দিনের পর দিন ছাড় দিয়েই যাচ্ছে সরকার, যার ফলশ্রুতিতে ব্যাংকিং খাতের বারোটা বাজছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কি করছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ঋণখেলাপিদের এ ধরনের ঢালাও সুযোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ঢেকে আনছে বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। জুন মাস শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা।
বিশেষ সুবিধা ও ছাড়ের পরও মহামারীকালে বাড়ছে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণের অংক। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। এই অঙ্ক মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। মার্চ মাস শেষে যা ছিল ৯ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে খেলাপি ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুযোগসহ নানা ছাড় দেওয়ার পরও এই চিত্র দেখা যাচ্ছে। জুন পর্যন্ত দেশের ৫৯টি ব্যাংক মোট ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল। আর মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।