নগরের পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জন্য ১৪ তলা একটি ভবন নির্মাণে গত জুন মাসে দরপত্র আহ্বান করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান। যার প্রাক্কলন মূল্য ছিল ৪৮ কোটি ৬৭ লাখ ৯৩ হাজার ২৭১ টাকা। ‘পরিচ্ছন্ন কর্মী নিবাস নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আরডিপিপি’তে (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) মাদারবাড়িতে ভবনটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। আরডিপিপি’টি এখনো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করেনি। অর্থাৎ আরডিপিপি চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই এ দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
এদিকে প্রকল্পটির প্রস্তাবিত আরডিপিপি’তে ৭৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব রয়েছে। বর্ধিত এ অর্থের ৮০ শতাংশ জিওবি অনুদান এবং ২০ শতাংশ চসিকের নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যয় করার সম্মতি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে স্থানীয় সরকার বিভাগ বর্ধিত অর্থের পুরোটাই নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যয় করার শর্তে আরডিপি পুনর্গঠনে চসিককে নির্দেশনা দেয়। বর্ধিত অর্থের পুরোটা ব্যয় করার সামার্থ্য নেই বলে জানিয়েছেন চসিকের দায়িত্বশীলরা। ফলে প্রস্তাবিত আরডিপিপি’র চূড়ান্ত অনুমোদন নিয়েও এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এ অবস্থায় চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে দরপত্র আহ্বানের যৌক্তিকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, দরপত্র আহ্বানের বিষয়টি তো আমি জানিও না। হয়তো ভুলে করেছেন। যদি এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয় তাহলে দরপত্র বাতিল করে দেব।
মেয়র অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির বাইরে এসে স্থানীয় সরকার বিভাগ আরডিপিপিতে প্রস্তাবিত বর্ধিত অর্থের পুরোটাই চসিককে নির্বাহ করার সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, এ বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখব।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান আজাদীকে বলেন, আরডিপিপি’তে মাদারবাড়িতে পরিচ্ছন্ন নিবাস নির্মাণের প্রস্তাব আছে। তাই কাজ এগিয়ে রাখতে দরপত্র আহ্বান করেছি। অন্য কোনো কিছু নেই এখানে। যদি কোনো কারণে আরডিপিপি চূড়ান্ত অনুমোদন না হয় সেক্ষেত্রে দরপত্রটি বাতিল করে দেব।
এ বিষয়ে চসিকের অবসরপ্রাপ্ত একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপকালে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে জানিয়েছেন, এখানে নিয়মের কিছুটা ব্যত্যয় হয়েছে। যদি ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দিয়ে দেয় তাহলে পুরোটাই অনিয়ম হবে। আরডিপিপি এখনো অনুমোদন পায় নি। আদৌ অনুমোদন হয় কীনা সেটাও অনিশ্চিত। এরপরও আরডিপিপি’তে প্রস্তাবিত একটি ভবন নির্মাণে দরপত্র আহ্বানের বিষয়টি কেবল কাজ এগিয়ে রাখার জন্য নাকি কারো পছন্দের কোনো ঠিকাদারের স্বার্থে হয়েছে সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
প্রকল্পটির শুরুর গল্প :
নগরের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে ‘পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে চসিক। যা ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ২৩১ কোটি ৪২ লাখ ৬৮ হাজার টাকায় অনুমোদন দেয় একনেক। এ প্রকল্পে সরকারি তহবিল (জিওবি ফান্ড) থেকে ১৮৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং বাকি ৪৬ কোটি ২৮ লাখ ৫৩ হাজার চসিকের নিজস্ব তহবিল ব্যয় করার কথা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালে জুন মাস পর্যন্ত। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
অনুমোদিত প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুযায়ি, এ প্রকল্পের আওতায় পরিচ্ছন্ন কর্মীদের জন্য ১৪ তলা বিশিষ্ট ৭টি ভবন নির্মাণ করার কথা। যেখানে ফ্ল্যাট থাকবে ১ হাজার ৩০৯টি। এর মধ্যে বান্ডেল কলোনিতে ৩টি, ফিরিঙ্গবাজারে ১টি, ঝাউতলায় ২টি এবং সাগরিকায় চসিকের নিজস্ব জায়গা ১টি ভবন নির্মাণ করা হবে বলে উল্লেখ আছে ডিপিপিতে। ভবনগুলোতে বসবাসকারী পরিচ্ছন্নকর্মীদের প্রতিটি পরিবারের জন্য দুইটি বেডরুম, একটি রান্নাঘর ও দুইটি বাথরুম থাকার কথা।
প্রকল্পের অগ্রগতি এবং আরডিপিপি’র প্রয়োজনীয়তা :
চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঝাউতলায় একটি ভবনের ১২ তলা পর্যন্ত হয়েছে। সেখানে অপর একটি ভবনের কাজ শুরু হয়নি। বান্ডেল কলোনির তিনটি ভবনের মধ্যে জায়গার অভাবে একটির কাজ হচ্ছে না। বাকি দুটির মধ্যে একটির ৮ তলা এবং অপরটির ১১ তলা পর্যন্ত হয়েছে। ফিরিঙ্গি বাজারে একটির চার তলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই হযেছে। এছাড়া বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়েছে সাগরিকায় নির্মাণাধীন ভবনটির।
এদিকে প্রকল্প এলাকার সেবকদের অন্য জায়গায় পুর্নবাসনে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। ফলে মেয়াদ শেষ হলেও শতভাগ কাজ শেষ হয়নি। তাছাড়া দুটি ভবন নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গত বছরের ৫ আগস্টের পর কাজ বন্ধ করে দেয়। তারা চুক্তি বাতিলের আবেদন করে। ফলে সব মিলিয়ে প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় প্রকল্পের আরডিপিপি প্রণয়নের।
পরবর্তীতে গত বছর আরডিপিপি প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে চসিক। যেখানে জায়গার অভাবে বান্ডেল কলোনিতে করতে না পারা ভবনটি পূর্ব মাদারবাড়িতে কর্পোরেশনের নিজস্ব জায়গায় করার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৩০৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। যা মূল প্রকল্পের চেয়ে ৭৮ কোটি টাকা বেশি। বর্ধিত এ অর্থের মধ্যে ৬৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা জিওবি অনুদান এবং ১৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা চসিকের নিজস্ব ফান্ড থেকে ব্যয়ের শর্তে আরডিপিপি’তে সম্মতি দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি আমলে নিচ্ছে না স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এদিকে আরডিপিপি এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। এর আগেই ৬ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। গত ১৩ জুলাই ছিল দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন। মোট ৫টি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। তবে গতকাল পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়নি।