বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস কী এবং কেন:
প্রতিবছর ২৮ শে জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গের হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের আবিষ্কার কে সম্মান জানাতে তার জন্মদিনে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়।এই বছর হেপাটাইটিস দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো “Hepatitis can’t wait” অর্থাৎ আর অপেক্ষা নয়, হেপাটাইটিস প্রতিরোধের এখনই সময়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর ২৮ শে জুলাই ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং প্রকৃত পরিবর্তনের উপর প্রভাব ফেলতে বিশ্বকে এক থিমের আওতায় নিয়ে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাইরাসঘটিত হেপাটাইটিস নির্মূলকরণের লক্ষ্যে এই দিবসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
হেপাটাইটিস কী :
হেপাটাইটিস লিভারের এক ধরনের প্রদাহ, আর ভাইরাল হেপাটাইটিস হলো ভাইরাসজনিত লিভারের রোগ। ভাইরাল হেপাটাইটিস সাধারণত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই এই পাঁচ ধরনের ভাইরাস দিয়ে হয়ে থাকে।
হেপাটাইটিস এ এবং ই হলো স্বল্পমেয়াদী পানিবাহিত রোগ। হেপাটাইটিস বি ও সি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী রক্ত বাহিত রোগ। হেপাটাইটিস এর ফলে জন্ডিস, ক্ষুধাহীনতা, দুর্বলতা, লিভারের স্থানে ব্যথা, জ্বর, শরীর ও পেশীর ব্যথা, বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
হেপাটাইটিস এর ইতিহাস :
হেপাটাইটিস মানবসভ্যতাকে আদিকাল থেকে বিপর্যস্ত করে এসেছে। অনেকে বলেন, হেপাটাইটিস-এর উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় তিন হাজার বছর আগে সুমেরীয় সভ্যতায়। সেখানে পোড়ামাটির ফলকে পাওয়া গিয়েছে জন্ডিস-এর বর্ণনা। সুমেরীয়রা মনে করতেন আহাজু নামে এক শয়তানের আক্রমণই এই অসুখের কারণ। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস প্রথম ৪০০ খ্রিস্টপূর্বে হেপাটাইটিসের নিখুঁত বর্ণনা দেন। খাদ্য হিসেবে তাঁর নিদান ছিল মধু আর জল। মধ্যযুগে আবার এই অসুখটিকে ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হত। রোগীকে ‘অপবিত্র’ বলে বর্জন করার নিদান দিতেন ধর্মযাজকেরা। হেপাটাইটিসের বড় শিকার সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে হেপাটাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হন এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত হেপাটাইটিসের কারণ বিজ্ঞানের কাছে ছিল এক প্রহেলিকা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এর কারণগুলি বোঝা সম্ভব হয়। ১৯৬৭ সালে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আবিষ্কার করলেন জেনেটিক বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ। তিনি বিভিন্ন অসুখের জিনগত সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করছিলেন। কাকতালীয় ভাবে এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসীর রক্ত পরীক্ষার সূত্রে আবিষ্কার করলেন হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসকে। তাই নাম দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্টিজেন। দু’বছর পরে ১৯৬৯সালে মাইক্রোবায়োলজিস্ট মিলম্যান-এর সঙ্গে আবিষ্কার করলেন হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন। হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-ডি, হেপাটাইটিস-সি এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস আবিষ্কৃত হল যথাক্রমে ১৯৭০, ১৯৭৭, ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ সালে। ব্লুমবার্গ তাঁর আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
হেপাটাইটিস এর তীব্রতা, বিশ্ব এবং বাংলাদেশ :
পৃথিবীতে মৃত্যুর প্রথম দশটি কারণ এর অন্যতম হচ্ছে হেপাটাইটিস। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রতিবছর এই রোগ গুলিতে মারা যাচ্ছে অন্তত ১৪ লাখ মানুষ। মৃত্যুর দিক থেকে পৃথিবীতে ক্যান্সারের পরে হেপাটাইটিস মূল কারণ হিসেবে রয়েছে অথচ হেপাটাইটিস নিয়ে বসবাস করা ৮০% মানুষ রয়েছে যারা জানেইনা তারা হেপাটাইটিস ভাইরাস বহন করছেন। কিন্তু সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিষেধক সুবিধা বাড়ানো গেলে এই ভাইরাস প্রতিরোধ সম্ভব। বাংলাদেশ প্রায় এক থেকে দেড় কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি বাহক বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস আক্রান্তদের মধ্যে বছরে ২০ হাজারের বেশি রোগী মারা যায়। শিশুদের মধ্যেও এখন এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর ২ থেকে ৫ লাখ নবজাতক হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে, যারা ভবিষ্যতে এই রোগের বাহক হয়। হেপাটাইটিস বি এইডসের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি সংক্রামক এবং প্রতি বছর এইডসের কারণে পৃথিবীতে যত লোক মৃত্যুবরণ করে তার চেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করে হেপাটাইটিস-বি এর কারণে। মনে রাখতে হবে সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে রক্তের মাধ্যমে ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত মানুষের অধিকাংশই জানেন না যে তাঁরা এই অসুখে আক্রান্ত। ল্যানসেট জার্নালের এপ্রিল ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী লিভারের ক্যানসারে আক্রান্তদের মধ্যে ক্রনিক হেপাটাইটিস-বি এবং সি-তে আক্রান্ত ছিলেন যথাক্রমে শতকরা ৪২.১ এবং শতকরা ৩১ ভাগ। অথচ রোগীরা নিজেরাই তা জানতেন না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, হেপাটাইটিস বি-তে সম্ভাব্য আক্রান্তদের শতকরা মাত্র ১০.৫ ভাগ নিজেদের সংক্রমণের কথা জানেন আর রোগ চিহ্নিত হয়েছে মানুষের শতকরা মাত্র ১৬.৭ ভাগ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকেন। এর কারণ, হেপাটাইটিস নির্ণয়, টিকাকরণ বা চিকিৎসার ব্যয়বহুলতা এবং অবশ্যই সচেতনতার অভাব।
করোনা সংক্রমণ এবং হেপাটাইটিস :
করোনা মহামারীতে গোটা বিশ্ব বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও এই ভাইরাসটি সংক্রমণ এবং মৃত্যু উদ্বেগজনকহারে বাড়াচ্ছে।বর্তমানে এখানে করোনার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। করোনাভাইরাস লিভার রোগীদের জন্য ক্ষতিকারক প্রমাণিত হচ্ছে। করোনার জন্মের পর এই ভাইরাসটি লিভারের রোগীদের জন্য খুব ক্ষতিকারক হিসেবে দেখানো হয়েছে যা ইতিমধ্যে লিভারের সমস্যা আছে এমন রোগীদের জীবন হুমকিতে পরিণত হয়েছে। করোনাকালীন এই সময়ে লিভার রোগীদের জন্য বিশেষ দৃষ্টি প্রদর্শন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, লিভার রোগীদের করোনার টিকা নিতে কোন বাধা নেই।
হেপাটাইটিস প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা :
১) ২০৩০ সালের মধ্যে ৯০% শিশুকে হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া।
২) মায়ের কাছ থেকে শিশুর শরীরে সংক্রমণ ৯০% কমানো।
৩) রক্তে হেপাটাইটিস সংক্রমণ ১০০% কমানো।
৪) ৯০% হেপাটাইটিস বি এবং ৮০% হেপাটাইটিস সি আক্রান্তের সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা।
ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ; আমাদের প্রত্যাশা এবং করণীয়:
প্রতিরোধ- নবজাতকের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধ। সমস্ত নবজাতকের জন্মের সময় হেপাটাইটিস বি-এর টিকা দেওয়া উচিৎ, তারপরে কমপক্ষে দুটি অতিরিক্ত মাত্রা বা ডোজ দিতে হবে।
সংক্রমণ রোধ- মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যে সংক্রমণ রোধ করতে হবে। সমস্ত অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের নিয়মিত হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে- মাদক সেবনকারী, বন্দি, অভিবাসী প্রত্যেকের হেপাটাইটিস পরীক্ষা, টিকা এবং চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া উচিৎ।
সমপ্রসারণ- পরীক্ষা এবং চিকিৎসার প্রাপ্যতা প্রসারিত করতে হবে। সময়মতো ভাইরাল হেপাটাইটিসের পরীক্ষা ও চিকিৎসা করালে লিভার ক্যানসার এবং লিভারের অন্যান্য গুরুতর রোগ প্রতিরোধ করা যাবে। কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়েও প্রয়োজনীয় হেপাটাইটিস পরিষেবাগুলি বহাল রাখতে হবে। করোনা মহামারীর মধ্যেও হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও যত্ন পরিষেবাগুলি যেমন- শিশু টিকাদান, মনিটরিং এবং দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি-এর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
তাই আর অপেক্ষা নয়, হেপাটাইটিস মুক্ত ভবিষ্যৎ গড়তে সচেতন হোন, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। রক্তের হেপাটাইটিস পরীক্ষা করুন, ডিসপজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করুন ও পরীক্ষিত রক্ত গ্রহণ করুন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, হেপাটোলজি (লিভার) বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।