(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এরপর প্রায় দুই বৎসর পর ২০১৮ সালে ছোট ভাই ইকবালের অনুরোধে কানাডা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর কানাডা ভিসার আবেদন পত্র, পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র আগ্রাবাদে চেম্বার বিল্ডিং এ অবস্থিত কানাডা ভিসা প্রসেসিং এজেন্ট এ জমা দিলাম। ওরা আবেদন পত্র পাসপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সিঙ্গাপুরে অবস্থিত ওদের হাই কমিশনে পাঠায়। প্রায় তিন সপ্তাহ পর ভিসা সহ পাসপোর্ট ফিরে আসলো। ভেলিড আমেরিকান ভিসা থাকায় এবং আমার পূর্বের এশিয়া ও ইউরোপের ভিসা থাকায় মাল্টিপল ভিসা পেতে অসুবিধা হল না। তারপর কাতার এয়ারওয়েজের টিকেট নিয়ে নির্ধারিত দিন ৩১ জুলাই ২০১৮ সালে এয়ারপোর্টে উপস্থিত হলাম। ফ্লাইটের নির্ধারিত সময় ছিল প্রায় রাত ২টা কিন্তু চেক ইন করার পর শুনলাম ফ্লাইট ২ ঘন্টা দেরীতে ছাড়বে। তাই কাতার এয়ারওয়েজের নির্ধারিত লাউঞ্জে খাওয়া-দাওয়া সেরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। কল করার পর ফ্লাইটে উঠে পড়লাম। বিজনেস ক্লাসের টিকেট তাই সুপরিসর আরামদায়ক আসন পেলাম। খাওয়া দাওয়াও বেশ ভাল ছিল। প্লেন ছাড়ার প্রায় ৫ ঘন্টা পর দোহার হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়াপোর্টে অবতরণ করলাম। প্লেনে আমার পাশে ছিলেন সস্ত্রীক আমাদের একজন সংসদ সদস্য। দোহায় আমাদের ট্রানজিট সময় ছিল প্রায় ৪ ঘন্টা। তাই আমরা কাতার এয়ারওয়েজে নির্ধারিত লাউঞ্জে গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে উনার সাথে গল্প করতে করতে প্রায় ৩ ঘন্টা কেটে গেল। তারপর নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০ মিনিট পর দোহা থেকে কানাডার মন্ট্রিলের পথে ফ্লাইট ছাড়ল। মন্ট্রিলে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০ মিনিট পর ফ্লাইট অবতরণ করল। তাতে আমার টেনশন বেড়ে গেল। কারণ মন্ট্রিল থেকে ১ ঘন্টা পর অটোয়া যাওয়ার জন্য আমাকে এয়ার কানাডার ফ্লাইট ধরতে হবে। মন্ট্রিল থেকে অটোয়ার আভ্যন্তরিন ফ্লাইট, তাই আমাকে ইমিগ্রেশন অতিক্রম করে লাগেজ নিয়ে পুনরায় এয়ার কানাডায় চেক ইন করতে হবে। কিন্তু মন্ট্রিলে ফরাসি কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসার অনেকক্ষণ সময় নিলেন এবং ব্যবহারও ছিল বেশ রূঢ়। এয়ার কানাডার চেক ইন কাউন্টারে এসে দেখলাম ফ্লাইট ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট দেরীতে ছাড়বে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ে ছাড়লে হয়তো আমার মিস হয়ে যেত। সময় থাকাতে আমি বোর্ডিং পাস নিয়ে ও লাগেজ দিয়ে কফি ও সেন্ডউইচ খেয়ে ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ফ্লাইট ছাড়ার ১ ঘন্টা পর অটোয়া পৌঁছলাম। আভ্যন্তরিন ফ্লাইট তাই বাহির হতে সময় লাগল না। আগমনী হলে আসতেই দেখলাম ছোট ভাই ইকবাল (কানাডায় একটি আমেরিকান কোম্পানীতে কর্মরত) আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সে বলল ও নাকি নির্ধারিত সময়ে আরো একবার এয়ারপোর্টে এসে ঘুরে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকে ওর বাসায় যেতে সময় লাগল প্রায় ৩০ মিনিটের মত। বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে বিকালের নাস্তা খেতে খেতে দেশ সম্পর্কে এবং আমার কানাডার ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ হল। ঐদিন আর কোথাও না গিয়ে দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ক্লান্তির কারণে রাতের খাবার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু জেট লেগের কারণে ভাল ঘুম হয়নি। পরের দিন সকালে ওর বাসার কাছাকাছি ঘুরে একটি ফলের বাগান দেখতে গেলাম যেখানে স্ট্রভেরি, আপেল, আঙ্গুর সহ বিভিন্ন জাতের ফলের বাগান দেখলাম। ঐ বাগান থেকে সস্তায় ফল কেনাও যায়। ঐদিন রাত্রে আমার কানাডা যাওয়া উপলক্ষে আমার আব্বার ফুফাতো বোন নাহিদের (সাবেক কন্ট্রোলার ও অডিটর জেনারেল ফারুক এম. সিদ্দিকীর ছোট বোন) বাসায় দাওয়াত। সন্ধ্যার পর ওর বাসার উদ্দেশ্যে আমি ও আমার ছোট ভাই ওর স্ত্রী লুবনা সহ রওনা দিলাম। নাহিদ অনেক পদের ভর্তা, শুটকি, সবজি, মাছ সাথে পোলাও কোরমা, রোস্ট ইত্যাদিও রান্না করেছিল। অনেক রাত পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া ও আড্ডা চলল। ওর বরও খুব আলাপি মানুষ। পরের দিন সকালে আমি ও আমার ভাই ইকবাল এবং ওর মেয়ে জুনাইনা সহ গাড়ি নিয়ে টরেন্টোর পথে রওনা দিলাম। সড়ক পথে অটোয়া থেকে টরেন্টোর দূরুত্ব প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার। প্রশস্ত হাইওয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটছে। রাস্তার দুই পাশে সবুজের সমারোহ। যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজ এবং অনেকদূর পর মাঝে মাঝে দুই একটা বাড়ি এবং গ্যাস স্টেশন। পথে লোকজন খুবই কম কিন্তু হরিণের আনাগোনা দেখলাম। ভাই একটা গ্যাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে গ্যাস নিল এবং আমরা কিছু হালকা পানীয় ও খাবার নিলাম। এখানে উল্লেখ্য কানাডা ও আমেরিকায় প্রত্যেক গ্যাস স্টেশনের পাশে ফাস্টফুড ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থাকে। আবার রওনা দিয়ে প্রায় ৫ ঘন্টা পর টরেন্টো পৌঁছলাম। আমরা মিসিসাগা অঞ্চলে পূর্ব নির্ধারিত হলিডে ইন হোটেলে উঠলাম। হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে অন্টারিও লেকের পাড়ে ঘুরতে গেলাম। লেক তো নয় যেন একটা সমুদ্র এবং লেকের পাশে দেখতে অনেকটা সমুদ্র সৈকতের মত। প্রচুর টুরিস্ট যে যার মত আনন্দ উপভোগ করছে। আইসক্রীম ও নানা খাবারের ফেরীওয়ালাও দেখলাম। রাতে টরেন্টোর বাঙালি পাড়া হিসেবে পরিচিত ডেইনফোর্ড এলাকায় ভাইয়ের এক বন্ধুর বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াতে গেলাম। ডেইনফোর্ড এলাকায় অনেক বাঙালিদের দোকান এবং বাংলা লিখা সাইবোর্ডও দেখলাম। পরের দিন সকালে টরেন্টোর কেন্দ্রস্থলে সি.এন টাওয়ার দেখতে গেলাম। টিকেট কেটে উপরে উঠে টরেন্টো শহরের ভিউ দেখলাম। ঐ এলাকা প্রায় সব বিল্ডিংই উঁচু, বিভিন্ন ব্যাংক এবং অফিস অবস্থিত। দুপুরে গেলাম আমাদের চট্টগ্রাম কলেজ ‘৭৭ এর বন্ধু (বর্তমানে প্রয়াত) প্রকৌশলী হাসানের স্কারবোরো এলাকার বাসায়, এলাকাটা একটা অভিজাত আবাসিক এলাকা। হাসানের স্ত্রী ডাঃ রুবিনা ভাবী (ডঃ মোঃ ইউনুসের ভাইয়ের মেয়ে) তখন বাসায় ছিলেন না। ওনি চেম্বারে ছিলেন কিন্তু হাসান ও ছেলেদের সাথে দেখা হল। আমরা চা-কফি, নাস্তা খেয়ে হাসান সহ বের হলাম আশেপাশে পুরো এলাকাটা ঘুরে এবং ছবি তুলে হোটেলে ফিরে গেলাম। হাসানের ঐ ছবি এবং স্মৃতিগুলি এখনও আমাকে কাঁদায়। পরের দিন সকালে আমরা কানাডার প্রান্তে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখার জন্য সড়ক পথে রওনা দিলাম। প্রায় দুই ঘন্টার কিছু কম সময়ে নায়াগ্রা পৌঁছলাম। নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকাটির নামও নায়াগ্রা। ঐ এলাকায় পৌঁছার আগেই অনেক দূর থেকে জলের শব্দ ও আকাশে জলকনা উড়তে দেখা যায়। জলাপ্রপাত এলাকায় ঢুকার আগে একটা সুন্দর পার্ক দেখলাম। তারপর কাছের থেকে আল্লাহর অপার সৃষ্টি এই জল প্রপাত দেখে এবং ছবি তোলে একটা এরাবিয়ান রেস্টুরেন্টে শর্মা দিয়ে লাঞ্চ সেরে এলাকাটা ঘুরে পুনরায় হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। পরের দিনে একই পথে আবার অটোয়ায় ভাইয়ের বাসায় ফিরে আসার জন্য দুপুরের দিকে রওনা দিলাম। পথে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই ভাই আমাকে বলল রাস্তায় যদি দূরের থেকে কোন জন্তু যেমন- হরিন, বিষ্ট (এক ধরনের বন্য প্রাণি), বনগরু ইত্যাদি দেখা যায় তাহলে আমি যেন ওকে আগে থেকে সাবধান করি। কারণ দ্রুত গতির গাড়ির নীচে এই সমস্ত জন্তু পড়লে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। যাইহোক ভালয় ভালয় রাত ১০টার দিকে অটোয়া পৌঁছলাম। ঐদিন অটোয়ায় ঢুকার মুখে বেশ ট্রাফিক জ্যাম ছিল।
পরের দিন সকালের দিকে আমরা কানাডার কুইবেক প্রদেশে মনট্রাম্লা নামক একটা পর্যটন এলাকা দেখার জন্য ভাইয়ের পরিবার সহ রওনা দিলাম। অটোয়া থেকে মনট্রাম্লা পৌঁছাতে সময় লাগলো প্রায় ২ ঘন্টা। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সাথে বিভিন্ন রকম রাইড সহ একটা সুন্দর পার্ক জায়গাটিকে নান্দনিক সুন্দর করে তুলেছে। ক্যাবল কারে পাহাড়ে উঠার, প্যারা গ্লাইডিং এবং বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন রকম রাইডের ব্যবস্থা আছে। এই জায়গাটা ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হল আমাদের কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান বা খাগড়াছড়িকে এই রকম করে গড়ে তুলতে পারতাম। এলাকাটিতে প্রচুর পাঁচ তারকা হোটেল, বিভিন্ন ধরণের রেস্টুরেন্ট আছে। প্রচুর দেশী, বিদেশী পর্যটক গিজ গিজ করছে। আমরা দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টের সামনে অনেক্ষন অপেক্ষার পর ভিতরে জায়গা পেলাম। ভরপেট খেয়ে আমরা হেঁটে এলাকাটা ঘুরতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তাই কিছুক্ষন ঘুরে ফিরার সিন্ধান্ত নিলাম। কারণ ঐসব দেশে আমাদের দেশের মত যেখানে সেখানে পার্কিং এর সুবিধা নাই। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করে হেটে ঘুরতে হয়। তারপর ফিরার পথে আমার ভাই হাইওয়ে ভুল করাতে অনেক দূর ঘুরতে হল তাতে আমার সুযোগ হল কুইবেক প্রদেশের বিভিন্ন জায়গা দেখার। পরের দিন সকালে আমরা অটোয়া থেকে মন্ট্রিলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। অটোয়া থেকে মন্ট্রিলের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার, আমাদের পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় ৩ ঘন্টা। দুপুর ১টার দিকে মন্ট্রিল পৌঁছে আমরা একটা পাকিস্তানী রেস্টুরেন্টে শিক কাবাব, পরোটা, বিরিয়ানী দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেলাম। ঐ রেস্টুরেন্টের পাশে একটা পিয়ার গাছে প্রচুর পিয়ার ধরে আছে দেখে আমরা কয়েকটা পিয়ার ছিড়ে খেলাম, গাছের থেকে ছিড়ে পিয়ার খেতে বেশ মজা লাগল। খাওয়ার পর আমরা মন্ট্রিল অলিম্পিক ভিলেজ দেখার জন্য রওনা দিলাম। কিন্তু পথের মধ্যে অলিম্পিক ভিলেজের কাছে আমাদের গাড়িকে পিছন থেকে অপর একটি ঝটঠ গাড়ি সজোরে ধাক্কা দিল।