সরকারি পাওনা আদায়ে দায়ের করা সার্টিফিকেট মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে বেরিয়ে আসা কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুর বলছেন, বরং তিনিই সরকারের কাছে টাকা পান। কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের ছোটগল্প ‘কাঁটা’ অবলম্বনে একই শিরোনামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরের সরকারি অনুদান পেয়েছিলেন টোকন ঠাকুর। অনুদানের অর্থ গ্রহণের নয় মাসের মধ্যে ছবি মুক্তি দেওয়ার নিয়ম থাকলেও আট বছরেও তা সম্পন্ন করতে পারেননি তিনি।
ছবি নির্মাণ শেষ করতে কিংবা অর্থ ফেরত চেয়ে একাধিকবার তাকে চিঠি পাঠিয়েও কোনও উত্তর না পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মামলা দায়ের করে তথ্য মন্ত্রণালয়। ওই মামলাতেই গত মাসে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সেই পরোয়ানায় গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকার কাঁটাবন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় টোকন ঠাকুরকে। খবর বিডিনিউজের।
সোমবার ঢাকার মহানগর হাকিম আবু নোমান মো. সুফিয়ান টোকন ঠাকুরকে জামিন দিলেও মঙ্গলবার নির্বাহী হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করার শর্ত দেন তাকে। কারণ তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি এ আদালতেই বিচারাধীন। শর্ত মেনে মঙ্গলবার নির্বাহী হাকিম ও জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার সোনিয়া হোসেন জিসানের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন টোকন ঠাকুর। এ আদালত থেকে পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিনও পেয়েছেন তিনি।
জামিন আবেদনের শুনানিতে তিনি বিচারককে বলেন, সরকার আমার কাছে টাকা পায় না, উল্টো আমিই সরকারের কাছে টাকা পাই।
আইনজীবী প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাসের মাধ্যমে জামিন চান টোকন ঠাকুর। বিচারক আইনজীবীর বক্তব্যের সঙ্গে অভিযুক্তের বক্তব্যও শুনতে চান। শুনানিতে টোকন ঠাকুরের আইনজীবী বলেন, সরকার থেকে প্রাপ্ত প্রথম ধাপের অনুদান ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়ে কাঁটা ছবির শতভাগ ফুটেজ ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়।
২০১৩ সালে অনুদান পেয়ে এত দীর্ঘ সময় লাগার কারণ দেখিয়ে আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, ছবির প্রেক্ষাপট এর অন্যতম কারণ। তিনটি সময় ১৯৬৪, ১৯৭১ ও ১৯৮৯-৯০ সালের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হচ্ছে কাঁটা। মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা এই ছবির অন্যতম বিষয়। পিরিয়ডিকাল ছবির প্রপস্, কস্টিউম ও সেট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য অনেকটা সময় লেগেছে। শ্যুটিং শেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা না পেয়ে আর্থিক সঙ্কট এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে এডিটিং, ডাবিং ও মিউজিকের কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
নির্মাতা টোকন ঠাকুর বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কাঁটা গল্পের লোকেশন পুরোনো ঢাকার ৩০-৩৫টি বাড়ি ও গলি। এই বাড়িগুলো ভেঙে ফেলে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের প্রথম কিস্তির টাকা অনুযায়ী ছবির ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের ফুটেজ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা। মন্ত্রণালয় সে ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দিয়ে দ্বিতীয় ধাপের শ্যুটিংয়ে যাওয়ার কথা। এই প্রক্রিয়ায় কয়েকমাসের সময় অতিক্রমের ফলে অনেকগুলো প্রাচীন বাড়ি ভাঙা পড়ে যাবে।
অর্থাৎ প্রথম ধাপের শ্যুটিংয়ের ফুটেজের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের ফুটেজের কন্টিনিউটি মিলবে না। যেহেতু পুরোনো ঢাকা একটি পাব্লিক লোকেশন, সেই অনুযায়ী পুরো ছবির শ্যুটিং আমি টানা করতে চেয়েছি এবং করেছি, যার প্রডাকশন বাজেট কোটি টাকা ছাপিয়ে যায়।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত ৩৫ লক্ষ টাকা যেহেতু এককালীন প্রদানের নিয়ম নেই এবং শ্যুটিং যেহেতু প্রাসঙ্গিক কারণেই একটানা করতে হয়েছে, সেকারণে পুরো ছবির বাজেটের টাকা আয়োজনে কিছুটা অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলেও কাজটি আমি একটানা শেষ করেছি।
মন্ত্রণালয় থেকে প্রথম ধাপে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়ে নিয়ম অনুযায়ী ৩০/৪০ মিনিটের ফুটেজের বদলে আমি জমা দিয়েছি পুরো ছবি, যা পাঁচ ঘণ্টার বেশি। মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্য বকেয়া ২৫ লাখ টাকার দ্বিতীয় কিস্তি বরাদ্দের জন্য কয়েকবার আবেদন জানিয়েছি এবং এখনও জানাচ্ছি।
মন্ত্রণালয় থেকে অবশিষ্ট টাকা পেলে সম্পাদনাসহ শব্দ, সংগীত সংযোজন করে চলচ্চিত্রটি চূড়ান্ত করে সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে পারবেন বলে জানান টোকন ঠাকুর। আদেশে বিচারক সোনিয়া হোসেন বলেন, চলচ্চিত্রটির যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে চূড়ান্ত প্রিন্ট জমা দিলে তা অবলোকনপূর্বক মামলা প্রত্যাহার করা হবে।
খাতক পক্ষের আবেদনের পর্যালোচনায় দেখা যায় তিনি ইতোমধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করে চলচ্চিত্র ফুটেজ তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রদান করেছেন। অতএব সার্বিক বিবেচনায় নিয়মিত হাজিরা প্রদান শর্তে একজন স্থানীয় গণ্যমান্য ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ কৌশলীর জিম্মায় পাঁচ হাজার টাকা বন্ডে জামিন মঞ্জুর করা হলো। খাতক/অভিযুক্তকে চলচ্চিত্র বিষয়ক হালনাগাদ প্রতিবেদন বাদীকে (তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখা) জানাতে বলা হলো।