আমার স্মৃতিতে মরহুম সেকান্দর হোসেন মিয়া

মেজর অবসরপ্রাপ্ত রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম

| সোমবার , ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

সেকান্দর হোসেন মিয়া অনেকের কাছে ‘লালু ভাই’ নামে পরিচিত। আমার জীবনে অনেক বন্ধু এসেছে, কিন্তু তার মতো অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা একে অপরের এত ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে সম্বোধন তুমি করেই হতো। আমি ডাকতাম, ‘লালু’ বলে। আর ও আমাকে ‘রফিক’ বলেই ডাকত। চট্টগ্রামের একজন সৎ, সাহসী, মেধাবী রাজনীতিবিদ ও সফল পৌর প্রধান ছিলেন সেকান্দর হোসেন মিয়া। সারাজীবন লালু সমাজের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিল। তার মতো অকৃত্রিম মানুষ আমি আর দেখিনি। বয়সে ও আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় হলেও আমরা ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৭০ সালে ইপিআরের দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আমি ওদের সার্সন রোডের পাহাড়ের পাদদেশে একটি বাড়িতে উঠি। সরকার এই বাড়িটি রিকুইজিশন করে ইপিআর এর অফিসারদের জন্য। আমি থাকতাম নিচের ঘরটিতে, লালু ও তার পরিবার থাকতো পাহাড়ের উপরে তাঁদের অনেক বড় একটি সুন্দর বাড়িতে। অসাধারণ দেশপ্রেমিক লালুর সাথে তখন থেকে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠনের সম্ভাবনা আসলো তখন পাকিস্তানিদের চক্রান্ত চলছিলো বাঙালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার। এসময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চরম অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে আমি যেমন উদ্বিগ্ন ছিলাম ঠিক তেমনি লক্ষ্য করেছি লালুও উদ্বিগ্ন ছিল। প্রতিদিন পাহাড়ের উপরের বাড়ি থেকে নেমে আমার সাথে দেখা করতো, এ বিষয়ে কথা বলতো। তার ভেতর দেশের ব্যাপারে যে অনুভূতি আমি লক্ষ্য করেছি তা সত্যি বিরল। ও মানুষকে খুব ভালোবাসতো এবং আমাকে বলতো ‘রফিক’ যদি পাকিস্তানিরা বাঙালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাহলে কি হবে। আমি বলতাম তুমি আমার কাছ থেকে সময়মত সংকেত পাবে এবং নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য তোমাকে আমি জানাবো। আমার মনে হচ্ছে একটা পর্যায়ে পাকিস্তানিরা বাঙালীদের উপর আক্রমণ চালাবে এবং এক ধরনের গণহত্যার মাধ্যমে এদেশের মানুষকে দমিয়ে ফেলার চেষ্টা চালাবে। লালু আমাকে বলতো, তুমি যা করার কর আমি তোমার সাথে থাকবো। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ এ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত করলো বাংলাদেশের মানুষ তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুরো চট্টগ্রাম বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলে কম্পিত হতে থাকে। তখন লালুর মধ্যে দেখা গেছে স্বদেশপ্রেম ও গভীর উত্তেজনা। ও বলত, পশ্চিমাদের সাথে আর না। এদিকে আমি যুদ্ধের জন্য একটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছিলাম এবং বুঝতে পারছিলাম যে, আমি যখন যুদ্ধ করবো তখন পশ্চিমারা আমার উপর আক্রমণ চালাবে- আমার ঘর ধ্বংস করবে। আমি যে বাড়িতে থাকি সেটা লালুর পিতা ইব্রাহিম সাহেবের। ঐ পরিবার আমার ঘনিষ্ঠ, তাই তাদের বাড়িতেও পশ্চিমা সৈন্যরা আক্রমণ করার অনেক সম্ভাবনা, তাদের উপর নির্যাতনও হতে পারে। ১৯৭১ সালের মার্চের ১৪ কি ১৫ তারিখ আমি লালুকে বলেছিলাম, পরিস্থিতি তেমন ভালোনা। তোমরা তোমাদের জিনিসপত্র এই বাড়ি থেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেল এবং তোমরাও অন্য কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নাও। এরমধ্যে একদিন পাহাড়ের উপর লালুর আব্বা আম্মার সাথে দেখা করি । বললাম খালু দেশের পরিস্থিতি ভালোনা। আপনারা নিরাপদ কোন স্থানে চলে যান। মনে হচ্ছে বড় কিছু হতে পারে। লালু ও তার বড় ভাইও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি লালুর বাবাকে বললাম এই জায়গা আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়। আপনারা মূল্যবান জিনিসপত্র এখান থেকে সরিয়ে ফেলুন। তাদের বললাম আমি এখানে নিরাপদ নই, পশ্চিমা সৈন্যরা যে কোন সময় আমার উপর আক্রমণ করবে। আমিও আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমাকে যখন আক্রমণ করবে তখন আপনাদের বাড়িতেও আক্রমণ করতে পারে। তাই আপনারা নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এতে উনি খুব চিন্তিত হলেন। আমাকে বেশ সাহস দিয়ে ইব্রাহিম সাহেব বললেন, তোমরা যা করার কর, আমরা আমাদেরটা দেখবো। কিন্ত তুমি পিছপা হবেনা। মার্চের ১৬ ও ১৭ তারিখের ঘটনা। এরিমধ্যে আমি যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছি। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। লালু প্রতিনিয়ত আমার সাথে দেখা করতো। শহরে কোথায় কি হচ্ছে সব কিছু আমাকে জানিয়ে তারপর বাসায় যেতো। এভাবে চলতে চলতে ২৪ মার্চ সন্ধ্যার দিকে আমি যুদ্ধ শুরু করে সীমান্তের সব ফাঁড়িগুলো দখল করার জন্য ইপিআর এ আমার বিশ্বস্ত বাঙালী সৈনিকদের নির্দেশ পাঠাই। এবং চট্টগ্রাম সেক্টরের সীমান্তের সব ফাঁড়িগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলি। কিছুক্ষণ পর আমি লালুকে বললাম তোমাদের এখানে আর থাকা ঠিক হবেনা। তোমরা আজকেই এখান থেকে চলে যাও, জিনিসপত্র সরিয়ে ফেল। সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং পাহাড়ের উপর নিজের বাসায় চলে যায়। আমি যে আশঙ্কা করেছিলাম তাই সত্যি হলো। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা বাঙালীদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং গণহত্যা শুরু করে! আমি ও যুদ্ধ শুরু করে এই সার্সন রোডের বাসা ছেড়ে রণাঙ্গনে চলে গেলাম। এরপর আর ঐ বাসায় আসা হয়নি। পাকিস্তানিরা আমার ঐ বাসায় ঢুকে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং সাত্তার নামে আমার এক সৈন্যকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। তারা পাহাড়ের উপর উঠে লালুদের বাসায় আগুন জালিয়ে রীতিমতো ধ্বংস্তূপে পরিণত করে। মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে বহু কিছু হারিয়েছে। লালুদের পুরো পরিবারটিও তখন অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাকিস্তানিদের এই পরিবারের উপর বেশি আক্রোশ ছিল। কেননা পাকিস্তানিরা জানতো ওদের সাথে আমার গভীর ঘনিষ্ঠতার কথা এই পরিবারটি আমাকে সাহায্য করেছে এবং এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকজনের যাতায়াত ছিল। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে লালু ও তার পরিবার সবকিছু হারালেও প্রাণে বেঁচে গেছে। যুদ্ধ চলাকালীন কঠিন সময়ে শত প্রতিকূলতার মাঝেও লালু মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ রাখতো। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হলো, ১৭ তারিখ আমরা চট্টগ্রাম শহর দখল করি এবং সার্কিট হাউজে আমার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। সেখানে আমি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। লালু সেখানে উপস্থিত ছিল এবং সবসময় আমার কাছে কাছে থাকতো। আমার কখন কি প্রয়োজন তা মেটাবার চেষ্টা করতো। যুদ্ধ শেষে আমি অনেকদিন চট্টগ্রামেই ছিলাম। সেখানে প্রতিদিন কাজের ফাঁকে লালু আমার সাথে দেখা করতো। এভাবে ও যতদিন জীবিত ছিল আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। তার মতো ঘনিষ্ঠ এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু আমার জীবনে খুব একটা পাইনি।
তার মৃত্যুতে আমি এমন একজন বন্ধুকে হারিয়েছি যার সাথে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। লালুর উপর আমার পূর্ণ আস্থা ছিল। যুদ্ধের পর আমাকে ও নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। তারপর আমি চলে গেলাম ঢাকায়। বেসামরিক প্রশাসনে যোগ দিলাম। কিন্ত লালুর সাথে আমার নিয়মিত টেলিফোনে কথা হতো। যোগাযোগ ছিল সবসময়। এরপর মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়ে লালু চট্টগ্রামের পৌর প্রধান হলো। পৌর পিতা হিসাবে দারুণ সফল হলো। জীবনে আমি অনেক মানুষের সাথে মিশেছি। সত্যিকার অর্থে লালুর মতো অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৯ সালে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চট্টগ্রামে লালু ছিল আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। লালু দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক কষ্ট পেয়ে ১৯৮৯ সালের ২১ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করলো।
অসুস্থ অবস্থায় কিছুদিন বনানীর একটা বাসায় থাকতো, আমি তাকে সেখানে দেখতে যেতাম। ও আমার হাত চেপে রাখতো, ছাড়তে চাইতো না সে হাত। তার মৃত্যুতে আমি গভীর বেদনা বোধ করি। এবং আমার জীবনের এই ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়ে একাকীত্ব অনুভব করি। লালুর মৃত্যুবার্ষিকীতে মহান আল্লাহর কাছে তার আত্মার শান্তি কামনা করি, তার পরিবারের জন্য দোয়া করি। আমি মনে করি লালু সারাজীবন মানুষের উপকার ও কল্যাণ করেছে। তাই মহান রাব্বুল আলামিন তার পরিবারকে ভালো রাখবেন এবং লালুকে বেহেশতে স্থান দেবেন। তার জন্য আমার অনেক দোয়া। (২০১১ খ্রিস্টাব্দ)।
লেখক : প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

পূর্ববর্তী নিবন্ধজিয়ার ভাস্কর্য নিয়ে প্রশ্ন না তোলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা উদ্দেশ্য প্রণোদিত
পরবর্তী নিবন্ধমডার্ন স্টিল ও এনজিএস সিমেন্ট কারখানাকে ১৩ লাখ টাকা জরিমানা