আমার মুক্তিযুদ্ধ

তেমিয় কুমার মুৎসুদ্দী | মঙ্গলবার , ২৩ মে, ২০২৩ at ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সময়টা ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত উত্তাল। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র হিসাবে এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। নানারকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে মনটা কিছুতেই স্থির রাখতে পারছিলাম না। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সরাসরি রেডিওতে প্রচার হতে না দেওয়া, বাঙালিদের নিধনের জন্যে প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান হতে বিপুল সংখ্যক সৈন্যসহ অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে আসা ইত্যাদি দুঃখজনক ঘটনাগুলি বাঙালিদেরকে প্রতিনিয়ত এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিচ্ছিল।

এল সেই চরম মুহূর্ত। ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ শুরু করে দিল। মে মাসের দিকে আমরা গ্রামের সমবয়সী ছেলেরা মিলে ঠিক করলাম কাউকে কিছু না জানিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব। অত:পর সুবিধা মত সময়ে আমরা প্রায় ৮/১০ জন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

প্রায় ৫/৬ দিন পায়ে হেঁটে পাহাড়জঙ্গল পেরিয়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দেমাকগিরিতে উপস্থিত হলাম। দেমাকগিরি পৌঁছে শরণার্থী শিবিরে একটু ঠাঁই করে নিলাম। ২/১ দিন পর আমিসহ ৫/৬ জন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এ অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, দেমাকগিরি জায়গাটি ছিল সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা একটি ছোট সামরিক ছাউনি। সামর্থেরও অতিরিক্ত লোকজনকে বাসস্থান আর অন্ন যোগান দিয়ে ট্রেনিং দেওয়ার মত সার্বিক অবস্থা তাদের ছিল না। প্রতিদিন সকাল ৯টার দিকে শুরু হয়ে মাঝখানে ১ ঘণ্টার বিরতি দিয়ে বিকাল বেলা ঘটিকা পর্যন্ত হালকা, মাঝারি অস্ত্র, আর গ্রেনেডসহ অন্যান্য গোলাবারুদের ট্রেনিং চলল। প্রায় এক মাস ট্রেনিং চলার পর হঠাৎ একদিন একজন ভারতীয় সৈনিক আমার ক্যাম্পে এসে হাজির। আমাকে নাম ধরে ডেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে হবে বলে তাঁর সাথে আমাকে যেতে বললেন। গিয়ে দেখলাম সামরিক কায়দায় সজ্জিত একটি ঘরে তিনজন উর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা বসে আছেন। তাঁদের সামনে একটা চেয়ার খালি ছিল। তাঁরা আমাকে সেই চেয়ারে বসতে বললেন। অত্যন্ত অমায়িকভাবে আমার সাথে তাঁরা কথা বলা শুরু করলেন। আমি অত্যন্ত সুস্থির সাবলীলভাবে তাঁদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক আলাপের পর আমাকে জানানো হল ক্যাম্প ছেড়ে ট্রেনিং গ্রহণের অবশিষ্ট সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে আমাকে থাকতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে একত্রে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে। তাঁদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে সেইদিনই ভারতীয় ক্যাম্পে চলে এলাম।

আমাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পোশাক দেওয়া হল। যাদের সাথে আমার থাকার ব্যবস্থা হল তারা সবাই তিব্বতী এবং ভারতের হিমাচল প্রদেশ থেকে কয়েকদিন আগে দেমাকগিরি এসেছে। সবাই পূর্ণ সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। হালকা, মাঝারি, ভারী সব ধরণের সামরিক অস্ত্র চালাতে তারা সক্ষম। প্রত্যেকের গলায় দালাইলামার একটি ছোট্ট ছবি ঝুলানো ছিল। অবসর সময়ে তারা সুর করে ধর্মীয় বই পাঠ করত আর দালাইলামার ছবি কপালে কিংবা মাথায় ঠেকাত।

তিব্বতীদের সান্নিধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে আমার দিনগুলো বেশ ভালভাবেই চলছিল। ১৩ই নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে নির্দেশ এল রাতেই যার যার অস্ত্র নিয়ে মার্চ করতে হবে। রাত প্রায় ১০টার দিকে চূড়ান্ত নির্দেশ এল। সবার মত আমিও সশস্ত্র অবস্থায় সম্পূর্ণ ভারতীয় সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে রওয়ানা দিলাম। অনেক চড়াইউৎরাই পেরিয়ে ১ রাত ১ দিন হেঁটে অবশেষে সন্ধ্যার দিকে পাহাড়ের উপর একটি ছোট সমতল জায়গায় এসে আমরা থামলাম। এতগুলো ভারতীয় সৈন্যের সাথে আমি একমাত্র বাঙালি। রাত প্রায় ১২টার দিকে নির্দেশ এল আবার মার্চ করার। প্রায় ২ কিলোমিটার যাওয়ার পর নির্দেশ এল যার যার অস্ত্র প্রস্তুত রেখে সুবিধামত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করার। কিছুক্ষণ পর শুরু হল তুমুল গোলাগুলি। আমিও নিজের অস্ত্র নিয়ে সবার মত সম্মুখ দিকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করলাম। এভাবে অনেকক্ষণ গোলাগুলি চলার পর আস্তে আস্তে গুলির আওয়াজ কমে গিয়ে একসময় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর ভোরের আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম পাকিস্তানী ক্যাম্পটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। তখন মাথায় পাগড়ি, মুখে বড় শ্মশ্রু ওয়ালা এক শিখ সামরিক কর্মকর্তা আমাকে ডেকে একখণ্ড সবুজ কাপড় আমার হাতে দিয়ে ক্যাম্পে পূর্ব থেকে পুঁতে রাখা ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের দড়িতে বেঁধে দিয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে বললেন। আমি ২/১ জন সহযোদ্ধার সাহায্য নিয়ে যখন কাপড়টি ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের দড়িতে বেঁধে ‘জয় বাংলা’ বলে জোরে শ্লোগান দিচ্ছিলাম তখন সবাই আরও জোর গলায় আমার সাথে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছিল। আনন্দে, উত্তেজনায় আমার কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছিল। আর দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু পড়ছিল। এ যেন আনন্দ অশ্রু। মনে মনে ভাবলাম এই ক্ষণটার জন্য বোধ হয় আমি গত রাতের যুদ্ধে মারা না গিয়ে বেঁচে আছি। আজ আমার ট্রেনিং নেওয়া সার্থক। আমি যেন আমার দেশের, আমার মাতৃভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধের অলিখিত ইতিহাসের এক অংশ হয়ে গেলাম।

আমাদের পরবর্তী অপারেশন ছিল রাঙ্গামাটি জেলার বরকল সেনাক্যাম্প। স্থানীয় পাহাড়ী লোকেরা আমাদেরকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। তারা নৌকা জোগাড় করে রাতের আধাঁরে পাকিস্তানী ক্যাম্প হতে বহুদূরে আমাদেরকে কর্ণফুলী নদী পার করে দিয়েছিল। প্রায় ৩ দিনের মাথায় আমরা পাকিস্তানী ক্যাম্পটি দখলে সফল হলাম। এরপর শুভলং, ফারুয়া শত্রু ক্যাম্পগুলি ধ্বংস করে একদিন সন্ধ্যার সময় আমরা রাঙ্গামাটি শহরে এসে উপস্থিত হলাম।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ করার মত অবস্থা আমার নেই। রাঙ্গামাটি শহরে ২দিন অবস্থান করার পর একদিন বিকাল বেলা আমরা চট্টগ্রাম শহরে চট্টগ্রাম কলেজের রেড বিল্ডিং এ এসে অবস্থান নিলাম। সেখানে রাত কাটিয়ে পরবর্তী দিন আমরা চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের ভি.আই.পি লাউঞ্জে এসে উঠলাম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। অথচ নিজ শহরে এসেও আমি রাউজান থানাধীন আমার গ্রাম আবুরখীল যেতে পারছি না। উর্ধ্বতন কমান্ডারের নির্দেশ ছাড়া এতটুকু নড়াচড়া করার অনুমতি ছিল না। অত্যন্ত কঠিন নিয়ম আর শৃঙ্খলায় বাঁধা সৈনিক জীবন। অনেক ভেবে চিন্তে স্টেডিয়ামে অবস্থান নেওয়ার দ্বিতীয় দিনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে গ্রামের বাড়িতে মাবাবাকে একবার দেখতে যাওয়ার জন্য আমার কমান্ডারের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলাম।

তিনি শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন এক শর্তে। আমার সাথে থাকা অস্ত্র তাঁর জিম্মায় রেখে পরদিন অবশ্যই গ্রাম থেকে ফিরে এসে তাঁর কাছে রিপোর্ট করতে হবে। আমি সানন্দে রাজি হলাম। অস্ত্রখানা তাঁর কাছে জমা রেখে তখনই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রায় ১২টার দিকে আমি গ্রামে এসে পৌঁছলাম।

পরদিন যথাসময়ে আমি চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে ফিরে আমার কমান্ডারের নিকট রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখলাম সমস্ত ঘর খালি। দরজা বন্ধ। জিজ্ঞাসা করতেই দারোয়ান জবাব দিল গত রাতেই তারা সবাই চলে গেছে। কোথায় গেছে দারোয়ান জানে না। আজ এতবছর পর তাদের চেহারাও আমার মনে নেই। শুধু তাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতি আমি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার স্বপক্ষে আমার কাছে কোনো দলিল বা প্রমাণ নেই। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমি আবার আমার অধ্যয়ন জগতে সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করলাম। তাই বোধ হয় আমার নামে কোন মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ইস্যু হয়নি। আজ আমি একজন সার্টিফিকেট বিহীন অখ্যাত, অজ্ঞাত, মূল্যহীন মুক্তিযোদ্ধা। মনে মনে ভাবি সার্টিফিকেটের কথা চিন্তা করে আমিতো সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি। শুধু হৃদয়ে ছিল অকৃত্রিম দেশপ্রেম আর মাতৃভূমিকে শত্রু মুক্ত করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। দেশকে স্বাধীন করার জন্য দেশবিদেশের বহু মানুষ বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করেছেন। তবে সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, যুবক বয়সে আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ভারতীয় সৈনিকদের সাথে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখ সারির যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক এবং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিছুটা অজ্ঞতা, কিছুটা অপরিপক্বতার কারণে আমি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হলাম। এতে অবশ্য আমার আক্ষেপের কিছু নেই। কারণ সেদিন আমি দেশমাতৃকার প্রয়োজনের তাগিদে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে সফল হয়েছি। আজ আমার দেশ স্বাধীন। এটাই তো আমার পরম পাওয়া। কিন্তু মনে বড় কষ্ট লাগে তখনি যখন দেখি কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে সরকারি ভাতা সহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা অবৈধ ভাবে গ্রহণ করে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছে। তাদের কে দেখে শুধু একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘ধরনী, তুমি দ্বিধা হও, মা’।

লেখক: যুগ্মপরিচালক (অব:), বাংলাদেশ ব্যাংক

পূর্ববর্তী নিবন্ধইতিবাচক মনোভাবই চেতনাকে জাগিয়ে তোলে
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় আ. লীগ নেতাকে মারধর ১৫ জনের বিচার শুরুর আদেশ