জগত সংসারে এমনও হয়! জননী তার ভিতর থাকা সাহিত্যের রস সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিচ্ছে! প্রত্যেক সন্তানের মধ্যে! মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহবধূ, একজন জননী, নিজের আকাঙ্ক্ষাকে নিজের রক্তের সম্পর্কগুলোর মধ্যে সঞ্চালন করে দিচ্ছে। জীবনের গোধূলীলগ্নে এক অপরাহ্নে এই আবিষ্কারে আমি একেবারেই বিহ্বল। আমার মা, আমার মা এটা কি করে সম্ভব করলেন? নিজের জীবনের চাওয়াকে কি করে রক্তের উত্তরাধিকারদের আকাঙ্ক্ষায় পরিণত করলেন?
আমরা ভাইবোন সাতজন। আটজন ছিলাম। একভাই জন্মের কয়েকদিন পরেই মারা যায় ধনুষ্টঙ্কার রোগে। আমি খুব ছোট। তবু স্মৃতিতে আছে ভাইকে চৈতন্যগলিতে কবর দেওয়ার পর আমার বিধ্বস্ত বাবা বাসায় ঢুকছেন, মার আর্তবিলাপ ‘আমার খোকাকে কোথায় রেখে এলে’! সামনের বাসার খালাম্মা (এডভোকেট গফুর সাহেবের স্ত্রী) মাকে শক্ত করে ধরে আছেন। নিজেও কাঁদছেন।
আমার মা মমতাজ বেগম স্কুল জীবন থেকেই লিখতেন। নানা এস. এম. মোফখ্খর ওকালতি জীবন শুরু করেন কোলকাতায়। ভবানীপুরে বাসা ছিল। আম্মার একেবারে শৈশব কাটে কোলকাতায়। পরে ঢাকায়। ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলে পড়তেন। তখন থেকেই লেখালেখি শুরু। কবি গোলাম মোস্তফার সাথে পরিচয়। আম্মার জীবন আম্মা নিজেই এঁকে গেছেন “আমার স্মৃতি: আমার জীবন” গ্রন্থে। পরে বাবার নামের সাথে মিলিয়ে লেখালেখিতে আম্মা নিজের নাম ‘মমতাজ সবুর’ লিখতেন।
আমি তখন স্কুলে, আম্মার লেখা জমা দেওয়ার জন্য কাটাপাহাড় লেনে আজাদী পত্রিকা অফিসে যেতাম। বাসায় বাবা আজাদী পত্রিকা রাখতেন। আজাদীর সাপ্তাহিক মহিলাদের পাতায় আম্মার লেখা ছাপা হতো। আমরা সব ভাইবোনই খুব উৎসাহের সাথে প্রতিদিনের পত্রিকা পড়তাম। সকালে বাবার পড়া শেষ হলেই, পত্রিকাটি কার দখলে যাবে তার একটা প্রতিযোগিতা ছিল। আম্মা পড়তেন দিনের কাজ সেরে। যেদিন আম্মার লেখা ছাপা হত সেদিন আম্মার চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখতে পেতাম। আমার উৎসাহ অন্যান্য ভাইবোনের তুলনায় একটু বেশিই থাকতো। কারণ পত্রিকা অফিসে লেখাটা আমিই দিয়ে আসতাম।
আম্মার সমসাময়িক চট্টগ্রামের সাহিত্যমোদীরা, পরবর্তীকালে আমার লেখিকা বোনদের কারণে তরুণ সাহিত্যসেবীরা, অনেকেই জানেন লেখার জন্য আম্মার সংগ্রাম, কষ্ট। সবটা কি জানেন? আমাদের বাসায় তখন কেরোসিন তেলের হ্যারিকেন বাতি। আম্মা গৃহস্থালীর সমস্ত কাজ শেষ করে, সবাইকে খাইয়ে-দাইয়ে, ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে বেশ রাতে লিখতে বসতেন। কারও যাতে ঘুমের ব্যাঘাত না হয় সে কারণে হ্যারিকেনের একপাশে কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখতেন। একসময় দাদা, দাদী, ফুফু, চাচারাও গুর্খা ডাঃ লেইনের বাসায় থাকতেন। আত্মীয়-স্বজন লেগেই থাকতো। আম্মাকে সবদিক সামাল দিয়ে লেখালেখি করতে হত। আমার ধারণা এতসব পরিশ্রম, রাত জেগে লেখালেখি, পরবর্তী সময়ে আম্মার রোগভোগের অন্যতম কারণ।
এখন আমি ভেবে অবাক হই, গত দশকের পঞ্চাশ/ষাটের দশকে, আম্মার বিয়ে হয় পঞ্চাশ দশকের প্রথমার্ধে, তৎকালীন সমাজে মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের একজন গৃহবধূ, সন্তানের জননী, কেবলমাত্র সাহিত্য সাধনার জন্য নিজের ভিতরকার আবেগ, অনুভূতিকে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য কি সংগ্রামটাই না করেছে! সংগ্রামইতো বটেই! কি সমাজ, কি পরিবার, সব কি অনুকূল ছিল! না, ছিল না। গত শতকের পঞ্চাশ/ষাট দশকের মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম সমাজে সাহিত্য অনুরাগের এই বিষয়টি তখনও তেমনভাবে চর্চিত হয়নি। কেবলমাত্র সাহিত্য সাধনার জন্য, গল্প/কবিতা লেখার জন্য সংসারের বধূটির, সন্তানের জননীটির রাত জাগার বিষয়টি ঐ সমাজে স্বভাবিক বিষয় ছিল না। শাশুড়ি-ননদের সাংসারে তো নয়ই। স্বামীও কি মা-বোনদের কারণে মাঝে মাঝে বৈরী হতেন না! এতসবের মধ্যে আমার মা লেখালেখি করেছেন। লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছড়া, কবিতা, গল্প, জীবনীসহ ছয়টি প্রকাশনা রয়েছে। ছেলেমেয়েরা প্রত্যেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেছে। যার যার মত সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। সংসারী হয়েছে। সবই আম্মার দেখানো মতে, করানো মতে। আম্মার ভরসার জায়গা ছিল নিজের পিতা এবং আপন ভাইটি। তাও যতটা না আর্থিক তার চেয়ে বেশি মানসিক।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য আম্মাকে অনেক বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছে। আমার বাবা সংসারে কোন সময় গোছানো ছিলেন না। নিজে আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু রাজনীতির উৎসাহটাই বেশি ছিল। বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ষাটের দশকের প্রারম্ভ থেকেই। স্বাধীনতার পর রাজনীতিতে আরও ব্যস্ত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তেমন করে কিছুতে উৎসাহী ছিলেন না। দাদা অনেকটা জোতদার ছিলেন। সে কালেই দাদাকে বাঁশখালীতে লোকেরা ‘সাহেব’ ডাকত। দাদার সহায়-সম্পদ, নাম-ডাক হাইকোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবীর সুন্দরী কন্যাকে নিজের আইনজীবী ছেলের বউ হিসাবে আনতে সহায়ক হয়েছিল। বাবা গ্রামে দাদার প্রচুর জমি-জমার উত্তরাধিকার ছিলেন। কিন্তু ঐসব ব্যাপারে বাবার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। আমি দেখি নাই। যদিও দাদার সন্তানদের মধ্যে বাবাই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং আইনজীবী ছিলেন। গত শতকের ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত বাবা বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, স্বাধীনতার পর দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটিতে ছিলেন, দক্ষিণ জেলা রেডক্রসের সহ-সভাপতি ছিলেন, ৭২’ থকে ৭৫ পর্যন্ত সরকারি উকিল ছিলেন কিন্তু আমাদের গুর্খা ডাঃ লেইনের পঞ্চাশ দশকের বেড়ার ঘরটা নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত বেড়ারই ছিল। উপার্জনে যাওয়ার পর ১৯৯৮ ইংরেজিতে আমরা তিন ভাই বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে ৫ তলা বিল্ডিংটি করি। আমার বাবা নির্বিকার মানুষ ছিলেন। কি সামাজিক প্রতিষ্ঠায় কি সম্পদের প্রতিযোগিতায়। সততা বাবাকে অর্জন করতে হয়নি। সততার বিপরীত যে একটা শব্দ আছে বা থাকতে পারে এটা আমার এসব ব্যাপারে নির্বিকার বাবা জানতেন না। জানার প্রয়োজন বোধ করেননি কোনদিন। প্রাসঙ্গিক না তবুও বলি আমার জীবনে বাবাকে নামাজ কাজা করতে দেখি নাই।
এমন লোককে নিয়ে আমার মা’র সংসার। সারাটা জীবন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য আমার মা’কে যে কি রকম সংগ্রাম করতে হয়েছিল তা লেখে বোঝানো যাবে না। কি অসাধারণ মহিলা ছিলেন আমার মা সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমরা প্রত্যেক ভাইবোন আজকে যে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, প্রত্যেকের জন্য তার ভিত্তিটা রচনা করে দিয়েছিলেন আমার মা। আমাদের লেখাপড়া, পেশা/চাকরি, সংসার, সন্তান, প্রত্যেক কিছু নিয়ে আম্মার উদ্বেগের সীমা ছিল না। আমাদের প্রত্যেক ভাইবোনের জীবনের গল্প আমার মায়ের জীবনের গল্প। আমার মা নিজের পরিশ্রম দিয়ে, অশ্রু দিয়ে, রক্ত দিয়ে আমাদের জীবন গড়ে দিয়েছেন। কেবল জন্ম দিয়ে নয়, নিজের সমস্ত জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রাঙিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেক সন্তানকে হাত ধরে পৃথিবীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তারপর ছুটি নিয়েছেন। ছুটি কি নিয়েছেন! নিতে পেরেছেন! এখনওতো প্রত্যেক সমস্যায় মায়ের মুখটা প্রথমেই মনে আসে। মনে মনে বলি, ‘আম্মা এখন কি করব বলে দাও’। হয়ত হ্যাঁ, হয়ত না, তবুও সমাধান হলে আবার চোখে ভাসে আম্মার হাসিমুখ। যেন বলছেন, আমি তো আছি।
ঠিক আছে, হয়ত এরকম মা আরও অনেক আছেন। বা এর চাইতেও বেশি সংগ্রামের কথা, কষ্টের কথা, অশ্রুর কথা আছে। কিন্তু এটাও কি আছে নিজের সাহিত্য অনুরাগের উত্তরাধিকার প্রত্যেক সন্তানের রক্তে সঞ্চালন করা! বোনদের কথাই আগে বলি। বোনদের মধ্যে বড়জন মহুয়া চৌধুরী নামেই পরিচিত। শিক্ষক। কবিতার বইয়ের প্রকাশনা আছে দু’টো। এখনও লেখালেখিতেই। দ্বিতীয় নাসরিন আলম শিক্ষক। প্রকাশনা নেই। তবে লেখালেখির ঝোঁক আছে। তৃতীয় বোন তহুরীন সবুর ডালিয়া শিক্ষক। এনায়েতবাজার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। গল্প ভ্রমণ শিশুসাহিত্য ছাড়াও কবিতার বইয়ের প্রকাশনা আছে তিনটি। সাহিত্য অঙ্গনে নিজের যোগ্যতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে। ওর বক্তৃতা আমি শুনেছি। বলে খুব সুন্দর। চতুর্থ বোন নাহিদ শিরীন পিয়া ব্যাঙ্কার এবং বাচিক শিল্পী। সেদিন ফেসবুকে আম্মাকে নিয়ে তার একটি ছোট লেখা আমাকে অভিভূত করেছে। আমার চোখে পানি এনেছে। আমি জানি সে আরও লিখবে। যে কথাটা বলা হয়নি, আমার মা’ও শিক্ষক ছিলেন বেশ কিছুদিন। মেনকা বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। চট্টগ্রামে মুসলিম মহিলাদের শিক্ষা অঙ্গনে আনার ক্ষেত্রে মরহুম বাদশা মিয়া চৌধুরীর বিরাট অবদান ছিল। আমার মা’কেও তিনি উৎসাহিত করেছিলেন। শ্বশুরকুলের অনীহা এবং আমার নির্বিকার বাবার কারণে আমার মা শিক্ষক হিসাবে বেশী দিন থাকতে পারেননি। তখনকার মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজে শিক্ষকতাকে চাকরি হিসাবে গণ্য করা হতো। প্রভূত ভূসম্পত্তি অধিকারীর আইনজীবী ছেলের বউ শিক্ষকতার চাকরি করবেন এটা মেনে নেওয়া অনেক পরিবারে কঠিন ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আম্মা সক্রিয়ভাবে চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ এবং মহিলা পরিষদের সাথে জড়িত ছিলেন। মহিলা পরিষদ পাথরঘাটা শাখার সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন।
ভাইদের মধ্যে বড়ভাই কফিলউদ্দীন ভাল চাকরিই করে বরাবর। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে অফিস থেকে সার্বক্ষণিক গাড়ি প্রথম আমার বড় ভাইয়ের। নিবেদিত লায়নস। কেবিনেট সেক্রেটারী ছিল কয়েকবার। আমাদের বাসাটা পাকা করা, হাউস বিল্ডিংয়ের লোন নেওয়া, সব তারই অবদান। আমি কেবল আর্থিক সহযোগিতা করেছি। আমার বড় ভাই এখনও লিখেনি। তবে বক্তৃতা করেছে অনেক। আমার বিশ্বাস সে লিখবে। এ বিশ্বাসটা কেন একটু পরে বলছি। আমার আগে আমার ছোট ভাই জিয়াউদ্দীনের কথা বলি। সে আইনজীবী। দীর্ঘদিন রাজনীতির সাথে জড়িত। একেবারে ছাত্রাবস্থায়। ছাত্রলীগ দিয়েই শুরু। সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ল’টেম্পলের নির্বাচিত ভিপি এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক। পাশাপাশি বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার। সুতরাং তাকে সুন্দরভাবে বলতে হয় এবং সে বলেও। প্রেস বিজ্ঞপ্তি, সভার রেজুলেশনতো তাকে লিখতেই হয়। কিন্তু সেও আম্মার পথে লিখবে কোন একদিন সেটা আমি জানি।
আমি কি করে জানি! যে বোন বা ভাই এখনও লেখে নাই সাহিত্যের কোন লেখা, কি করে বলছি লিখবে কোন একদিন। কারণটা আমি, আমি নিজেই। আমি কোনদিন গল্প, কবিতা লিখিনি, পেশার কারণে লিখতে হয়। সে আইনের লেখা। বিষয় দিয়েই শুরু করতে হয় তবে সেটাকে ঠিক সাহিত্য বলা যায় না। সেই আমি এই বয়সে, এই সময়ে মানে লকডাউনের সময়ে যখন কোর্টে যেতে হয় না, লিখতে শুরু করলাম। কয়েকটা লেখা ফেসবুকে দিলাম। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনরা অবাক। কয়েকটা লেখা পড়ে আমার আত্মীয়-স্বজন, পুরানো বন্ধু-বান্ধবরা বলল এটা তোমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমারও মনে হচ্ছে আমি পারব এবং লিখব। বাকি জীবনে একখানা পাঠযোগ্য উপন্যাস নচেৎ দু’একটা ছোটগল্প অথবা চমকে দেওয়ার মত একখানা কবিতা। নিদেনপক্ষে নিজের যে দিন গেছে সেদিন নিয়ে। আরে আম্মাতো হাসছে। অভয়ের হাসি। যেন বলছে, পারবি, কেন পারবি না? তুইতো আমারই ছেলে, আমারই উত্তরাধিকার।
লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ