আমার মা, আমার স্পন্দন

রুমানা নাওয়ার | মঙ্গলবার , ২৭ মে, ২০২৫ at ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

এক দুপুরে আম্মার চোখে পানি। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে আম্মা? কাঁদছেন কেন? আম্মা আরও ততোধিক চোখের জল ফেলে যা বললোতার জন্য কখনও প্রস্তুত ছিলাম না।

আমি মারা গেলে তোদের কে দেখে রাখবে? আমি কীভাবে থাকবো আমার কলিজার টুকরোগুলোকে ছেড়ে। আম্মা আরও বললোতার প্রয়াত মাও নাকি এসব ভেবে ভেবে কাঁদতেন। আম্মার ও নানীজানের মতোন চিন্তাটা মাথায় আসলো বলে আম্মা কাঁদছেন। বলা বাহুল্য আমার নানীজান জাহানারা বেগম অল্প বয়সে মারা যান তাঁর সাজানো বিশাল সংসার রেখে। আম্মা বলেন বেশি সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে তাঁর মায়ের অকাল মৃত্যু হয়েছে। আমার আম্মারা ১১ ভাইবোন। আম্মার অবস্থান ৩য়। আমার আম্মা মরজিয়ানা বেগম। বাবার দেয়া আদরের নাম। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পাইন্দেংর বিখ্যাত বড় মৌলভী বাড়ি তোরাবিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বিশিষ্ট দানবীর শহিদুর রহমান চৌধুরী ছিলেন তৎকালীন জেলা জুরিবোর্ডের সম্মানিত সদস্য এবং পাইন্দং হেদায়েতুল ইসলাম দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। রত্নাগর্ভা মা জাহানারা বেগম নিজের সন্তানদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার পাশাপাশি পাড়ার মেয়েদের কোরআন এবং বাংলা শিক্ষা দিতেন। দাদা, মৌলানা তোরাব উদ্দীন আহমদ ছিলেন আরবী ভাষার সাহিত্যিক। তাঁর রচিত খুতবায়ে রশিদিয়া (১৮৮০ খৃষ্টাব্দ) কলকাতা থেকে প্রথম মুদ্রিত হয়। খুৎবাটি উপমহাদেশের বিভিন্ন মসজিদে পাঠ করা হতো। তিনি বুযুর্গানে দ্বীন ও আধ্যাত্মিক সাধক হিসাবে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভ করেন। নানা হাজী চুন্ন মিঞা ফরহাদাবাদের বিখ্যাত গুণী জন। দানবীর হিসেবে পরিচিত। মামা মাওলানা আফজল হোসেন চৌধুরী নাজিরহাট কলেজ নাজিরহাট আহমদিয়া আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা।

আমার বড়খালা ফরিদা বেগম এবং মেজো মেয়ে মরজিয়ানা বেগমকে শহরে রেখে পড়াশোনা করাতে লাগলেন। নগরীর গুলএজাহার বেগম স্কুল আম্মাদের স্কুল। আমার নানী তখনকার দিনে ৫ম শ্রেণি থেকে বৃত্তিপ্রাপ্ত মেধাবী স্টুডেন্ট দীর্ঘাঙ্গী অবয়ব আম্মার। বড় জেঠু সুন্দর আর খানদানি পরিবার দেখে ভাইকে বিয়ে দেন। আমার আব্বারও অহংকার ছিলো আম্মাকে নিয়ে। আমার মা যাকে আমি আম্মা ডাকি। মুখ ভরে ডাকি প্রাণভরে ডাকি। ছোটবেলায় আম্মাকে জড়িয়ে না ধরলে ঘুমুতে পারতাম না। এ বড়বেলায় এসেও আম্মার কাছে ছুটে যাই। উদ্দেশ্য একটাই আম্মার হাত জড়িয়ে আম্মাকে জড়িয়ে থাকা। আহা শান্তি কী মধুর সুখ। পৃথিবীর আর কোথাও কি মেলে এমন সুখ? আমার জানামতে না। আম্মার গায়ের ঘ্রাণটা অদ্ভুত সুন্দর। দশ হাত দূরে থেকেও সে ঘ্রাণ পাই। আম্মা হেঁটে গেলেও বাতাসে কী সুবাস ছড়ায় তা কেবল আমিই জানি। এ সুবাস হাজারো ফুলের সুঘ্রাণেও মিলে না। আমার সুন্দর নিপাট আম্মা। পানপাতার মতো মুখ। টিকালো নাক। আর প্রতিটা শাড়িতে আম্মাকে ভীষণ মানায়, সুন্দর লাগে। আমার আম্মা সাদা শাড়ি পরেন না, পরতে চান না। আব্বা মারা যাওয়ার পর আম্মা হাতে চুড়ি নাকে নাকফুল কানে দুল পরেন না আর। ব্লাউজও পরেন ফুলহাতা। কিন্তু সাদা শাড়িতে আম্মার আপত্তি। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে আম্মা প্রচুর শাড়ি গিফট পায়। সেটা ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে নাতি নাতনী বেয়াই বেয়াইন আরও অনেকে। সব শাড়ি কালারফুল, চমৎকার। আম্মা মুখে বলেন এতএত শাড়ি কেন কিনিস আমার জন্য। শাড়ি না দিয়ে টাকাটা দিয়ে দিলে পারিস। কিন্তু মনে মনে খুশিই হয়। সেটা আম্মার চেহারা দেখলেই বুঝতে পারি। এবং যতো দামী শাড়িই হোক আম্মা দু তিন মাসের বেশি একটা শাড়ি পরে না। এতে আম্মার নতুন শাড়ির কালেকশন খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। আর উনার যাকে ভালো লাগে তাদের আবার উনার শাড়ি গিফট করে। আম্মার দরাজ দিল হাতখোলা স্বভাব সারাজীবন। মানুষকে দিতে খাওয়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। যখন আব্বার একার আয়ে সংসার চলতো। আমরা ছোটছোট আট ভাইবোনের পড়ালেখা আম্মার অসুখ সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস তাদের জীবনে। তবুও আম্মা আব্বা দুজনে সব সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে শিক্ষিত করেছেন। সেরা খাবারটা সন্তানের মুখে তুলে দিয়েছেন। আব্বার সেসব স্ট্রাগলের দিনে আমার আম্মাই ছিলেন আব্বার একমাত্র সহযাত্রী। তাইতো আব্বাকে হারিয়ে আমার মা দিশেহারা পাগলিনী। যেমন হয়েছিলেন তার তেরো বছরের কিশোরী কন্যাটিকে হারিয়ে। আমাদের আর এক বোন নাজনীন সুলতানা রিবন। বয়সের তুলনায় বাড়ন্ত ছিলো বেশি। সে বোনটা হঠাৎ করে হারিয়ে গেলো আম্মার থেকে আমাদের থেকে। প্রায়ই সময় দেখতাম আম্মা রাতের বেলা বোনের কবরে সামনে গিয়ে কাঁদছে। এমন একটা দিন নেই রাত নেই আম্মাকে কাঁদতে দেখেনি। আমাদের শিশুকালটা কেটেছে সন্তানহারা এক মায়ের বিলাপ শুনে শুনে। আমাদের সবার ছোট ঝুমা আসলো আম্মার শূন্য বুক পূর্ণ করতে। আম্মা আস্তে আস্তে শোক ভুলতে লাগলেন। সন্তান হারানো কী কষ্টের তা আমার মা কে দেখেই বুঝেছি জেনেছি। আম্মা দুহাত তুলে ফরিয়াদ করেআর কোন সন্তান যেন আম্মা বেঁচে থাকতে মাবুদ নিয়ে না যায়। এমন মাকে ভুলে কীভাবে থাকবো জানি না। যে মা দুদিন না দেখলে উতলা হন। অস্থির হন। সে মাকে ফেলে কীভাবে থাকবো। মা ডাকের এ মধুর ধ্বনিএ উপহার আল্লাহর দেয়া সেরা নেয়ামত। একে উপেক্ষা করার সাধ্য কার!

লেখক: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবার আর্তনাদ
পরবর্তী নিবন্ধবিতার্কিক হিসেবে নৈতিকতা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে সমপৃক্ততা