‘আমি আর লিখবো না’ এটা আর নিছক কোনো সাহিত্যিক ক্লান্তির আর্তি নয়, বরং একটি যুগের, একটি বিবেকের স্তব্ধ ঘোষণা। এই বাক্য উচ্চারণ করছি আজ আমি, আমার প্রিয় বড় ভাই, চট্টগ্রামের খ্যাতিমান লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সমাজসেবক মরহুম সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাই এর জন্য। তিনি আর লিখবেন না। তবু তাঁর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি গ্রন্থ, প্রতিটি কলাম আজও বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ের স্পন্দনে, জাতির স্মৃতির ভাঁজে। ১৯৫৫ সালের ২০ এপ্রিল আগ্রাবাদ, চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া মজনু ভাই শুরু থেকেই ছিলেন জিজ্ঞাসু, অনুসন্ধিৎসু এবং এক সাহসী হৃদয়। ছোটবেলায় কিশোর বয়সেই ‘দৈনিক দেশ বাংলা’–তে সংবাদ লেখার মাধ্যমে তাঁর কলমের যাত্রা শুরু। ’৭১–এ দেশের সংকটকালে তিনি শুধু লিফলেট বিলি করেই থেমে যাননি, বরং জনমত গঠনে সাহসের সঙ্গে ভূমিকা রেখেছেন। শিক্ষাজীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে তিনি গবেষণার কঠিন পথে পা রাখেন। ১৯৮৮ সালে ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র’ এর মাধ্যমে তাঁর সংগ্রামী গবেষকসত্তা জেগে ওঠে। তিনি বেছে নেন চট্টগ্রাম শহরকে একজন নিরলস তথ্যসংগ্রাহক হিসেবে শহরের বধ্যভূমি, নির্যাতন কেন্দ্র, গোপন ঘাতক বাহিনী, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎ সবকিছুকে খণ্ড খণ্ড করে একত্র করেন বিবেকের জালের মতো। তাঁর অসাধারণ প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে: ১. নির্যাতন ’৭১, ২. চট্টগ্রামের বধ্যভূমি, ৩. রণাঙ্গনে সূর্যসৈনিক, ৪. মুক্তিযুদ্ধে আমার কৈশোর। এই সব গ্রন্থ নিছক ইতিহাস নয়, এগুলো বিবেকের ঘরে আলো জ্বালানোর আগুন। ‘চট্টগ্রাম শহরের বধ্যভূমি’ গ্রন্থে তিনি একে একে ৫১টি বধ্যভূমির তালিকা দেন। লিখেছিলেন ‘নৃশংসতার সাক্ষ্য বহন করে যে সব জায়গা, তার বেশিরভাগই আজ স্মৃতিহীন।’ প্রশ্ন রেখেছিলেন রাষ্ট্র কেন নিশ্চুপ?
মজনু ভাইয়ের একটা ঘর ছিল, যেন এক চলন্ত গ্রন্থাগার। চারদিকে বইয়ের স্তূপ, ফাইলের পাহাড়, আর মধ্যখানে এক নিঃশব্দ সাধক। সেই ঠাণ্ডা চোখজোড়া কী নিখুঁতভাবেই বুঝে ফেলত কার লেখা থাকবে, কারটা সময়ের গ্রোতে মুছে যাবে। বই ছিল তাঁর বন্ধু, সত্য ছিল তাঁর ঈশ্বর। তিনি বলতেন, ‘কলম চালাতে হলে বিবেক জাগ্রত থাকতে হয়।’
তাঁর প্রতিটি লেখা ছিল কষ্টের ভেতর খোঁজার ফসল। ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকায় টানা প্রায় ৩৬ বছর তিনি লিখেছেন জনপ্রিয় কলাম ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি’। এই কলামে উঠে এসেছে শহরের নীরব কান্না, সাধারণ মানুষের গোপন যন্ত্রণা, মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিময় স্মৃতি। তাঁর কলম ইতিহাস রচনা করত; ইতিহাস বিকৃতি নয়, সত্য উদ্ঘাটন ছিল তার ধর্ম। তাঁর শেষ জীবনে, যখন তাঁর চোখে রাজনীতি কালো হয়ে উঠেছে, ইতিহাসে বিকৃতি ঠাঁই পেয়েছে, তখন তিনি আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন প্রান্তিক সত্য বলায়। তিনি বলতেন, ‘যারা নিরক্ষর, যারা ভীরু, যারা শিশুর মতো সরলতাদের জন্যই আমার কলম।’ এমন একজন মানুষের থেমে যাওয়া মানে কেবল লেখক–মানুষটির প্রস্থান নয়, বরং আমাদের চেতনাজগতের এক নক্ষত্রের অবসান। ২০২১ সালের ১ মে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর চলে যাওয়ায় আমরা কেবল একজন লেখককে হারাইনি, হারিয়েছি এক বিবেকবান অভিভাবককে যিনি নিরলস গবেষণায়, নীরব সংগ্রামে, শব্দের মিছিলে আমাদের পথ দেখাতেন। আমি জানি ‘নক্ষত্র কখনো মরে না, সে আলো হয়ে ফিরে আসে ভবিষ্যতের কারো চোখে।’ তাঁর লেখার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি বই আমাদের শিক্ষা দেয় একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষ কতটা একা হতে পারে, কিন্তু সেই একাকীত্বই একদিন হাজার মানুষের ভাষা হয়ে ওঠে। তাঁর এই নিঃশব্দ গমন আমাদের সামনে রেখে যায় এক তীক্ষ্ণ প্রশ্ন : ‘সত্য বলার এই সাহসটা আমরা কি ধরে রাখতে পারি?’ আমার ভাইটি আর লিখবে না। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় যিনি ইতিহাসকে হৃদয় দিয়ে লিখতেন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক