আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | বৃহস্পতিবার , ১২ মে, ২০২২ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

বয়স্কজনের প্রতি সেবার মনোভাব বাড়াতে হবে

মা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পুত্র-কন্যারা মাকে নিয়ে অনেক কথা লিখেছে। একজন পুুত্রের একটা কথা আমার খুব ভালো লেগেছে। ‘একদিন তোমাকে নিয়ে পৃথিবী ঘুরবো’। আমাদের দেশে প্রায় মা সংসার থেকে কিছুটা অবকাশ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন না। এমনকি মাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রয়োজনীতা অনেক সন্তান ভাবেন না। অথচ মা কিন্তু স্বপ্ন দেখেন ছেলে মেয়েরা একদিন বড় হবে মা তাদের সাথে অনেক জায়গায় বেড়াতে যাবেন।

মায়ের বিয়ে হয় সাধারণত: পনেরো ষোল সতেরো- ১৮ বছর থেকে একুশ বছরের মধ্যে। কিশোরী অথবা সদ্য তরুণী সংসারে চরণ রাখার সাথে সাথে তাকে সংসারের কাজে অংশ গ্রহণ করতে হয়। আজও অনেক নারী সংসার সামলাতে গিয়ে লেখাপড়া অথবা চাকরি করতে পারে না। এমনকি অনেক উচ্চ শিক্ষিত নারী উঁচু পদে চাকরি করতেন। তাদের আক্ষেপ করতে শুনেছি সংসারের জন্য অথবা ছেলেমেয়েকে দেখাশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ মায়ের যখন বয়স বাড়ে তখন ছেলেমেয়েরা নিজেদের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মায়ের সাধ-আহ্লাদ আশা- আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভাবে না। সন্তান বড় হয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের নিয়ে রোজার ঈদে বেড়াতে যায়। কুরবানির ঈদে বেড়াতে বিভিন্ন জায়গায় অর্থবান হলে তো সমস্যা নেই। সপরিবারে মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, ইউরোপ অথবা নেপাল-ভুটান সামর্থ অনুযায়ী বেড়াতে যান। মা বেচারা বৃদ্ধ স্বামী নিয়ে সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকেন রান্না করেন, (আজকাল গৃহকর্মী নেই সাহায্য করার জন্য) অতিথিদের যত্ন করে খাওয়ান। বৃদ্ধ বা বয়স্ক অথবা অসুস্থ স্বামীর দেখাশোনা করেন। এযুগে বেশিরভাগ বউমা চাকরি করেন। তাই শাশুড়িমাকে সংসার সামলানো, স্বামীকে দেখাশোনার সাথে সাথে নাতি-নাতনিদেরও দেখতে হয়। এদেশে বিনা বেতনে বেবি সিটার দাদি-নানির অভাব নেই। দাদি- নানিরা অবশ্য স্নেহের বশে নাতি-নাতনিদের আদর করেন (সহজাত প্রবৃত্তিতে)। কিন্তু একজন মায়ের কি এতটুকু অবসর অথবা আরাম করার সৌভাগ্য কখনো হবে না। দু’একজন ব্যতিক্রম আছেন। কিন্তু এদেশে খুব কম সংসারে ব্যতিক্রম দেখা যায়।

এবার ঈদের পরদিন আমার মেয়ে আমাকে প্রায় জোর করে কক্সবাজারে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে আমার খুব ভাল লাগানো। এই প্রথম ঈদের পরে সম্পূর্ণ অবকাশ পেলাম। না হলে ঈদের পর তিন-চার দিন তো অতিথি আপ্যায়নে বেশির ভাগ মায়ের মত আমারও সময় অতিবাহিত হয়। ঈদের সময় কক্সবাজারে প্রচুর ভিড়। বেশির ভাগ তরুণ স্বামী-স্ত্রী অথবা ছেলেমেয়ে নিয়ে মধ্যবয়সী মা-বাবার বেড়াচ্ছে। তাদের আনন্দ দেখে ভাবছি আমার মত বয়স্ক মা কোথায়? আজও কি ঘরের দায়িত্ব পালন করতে তাঁরা ঘরেই রয়ে গিয়েছেন।

বিয়ের পর প্রথম কঙবাজারে গিয়ে গিলাম আমার শাশুড়ি আম্মা ও ছোট দেবরকে নিয়ে। কারণ আমি যখন সুটকোসে গুছিয়ে রাখছি, শাশুড়ি আম্মাকে বললাম “আম্মা আপনি কক্সবাজারে গিয়েছেন” মা বললেন আমরা বুড়ো হয়ে গিয়েছি কে আমাদের নিয়ে যাবে? শুনে খুব কষ্ট লাগলো আমি বললাম মা আপনিও আমাদের সাথে চলেন। মা খুব খুশি হলেন। কক্সবাজারে গিয়ে সমুদ্র দেখে মায়ের কি আনন্দ। খুব ভোরে সাগর সৈকতে ঝিনুক পাওয়া যেতো। শাশুড়ি আম্মা উচ্ছ্বসিত আনন্দে ঝিনুক কুড়িয়ে আমার হাতে দিতেন। অথচ মায়ের তখন বয়স হয়তো পঞ্চান্ন হবে (কারণ তেরো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল)। কিন্তু তিনি এবং অন্যরাও মনে করতেন শাশুড়ি আম্মা বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। আমার আম্মাকে আমি কক্সবাজার নিয়ে যেতে পারি নি। আব্বা সরকারি চাকরি করতেন তাই আম্মা ভারতের মালদহ-কলকাতা এবং বাংলাদেশের অনেক জেলা মহকুমায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু ঘরের কাছের সমুদ্র দেখা হয় নি।

আব্বা অসুস্থ এবং সংসারের দায়িত্ব শেষ বয়সে আম্মাকে যেন আরও বেশি ব্যস্ত করে রেখেছিল। আমার ভাই হজ্বে যাবার আগে আম্মাসহ আমাদের ভাইবোন সবাইকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে নিয়ে গেলো। কিন্তু আম্মা তখন বয়সের কারণে তেমন হাঁটতে পারেন না। বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারছেন না। একটা চেয়ার এনে আম্মাকে বসিয়ে সবাই সমুদ্রের কাছে গেলাম। আম্মা দূর থেকে সমুদ্র দেখলেন। আমাদের ভাই বোনদের খুব কষ্ট লেগেছিল। চোখের পানি মুছে ভাবলাম আম্মাকে নিয়ে কুমিল্লার ময়নামতি ঢাকার রমনা পার্ক, সাভারের স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনারে গিয়েছি। আম্মা এবং শাশুড়ি আম্মাকে নিয়ে আমরা প্রায়ই বেড়াতে যেতাম। কিন্তু আমার আম্মাকে নিয়ে কক্সবাজারে যাওয়া হয় নি। সে দুঃখ আমার এখনও মনে রয়ে গিয়েছে।

যুগ পাল্টে গিয়েছে। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। মা বাবাকে সন্তানসহ সময় করে বেড়াতে যেতেই হবে। অনেক মা খুব সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আসলে কর্মজীবী বা গৃহিনী প্রত্যেক মায়ের সময় কাটে সংসার ও সন্তান-স্বামীর কথা চিন্তা করে। সকাল থেকে চিন্তা করতে হয় প্রাত:রাশ, দুপুরের খাবার, বিকেলের নাস্তা, রাতের খাবার অতিথি আপ্যায়ন ইত্যাদির ব্যবস্থা করা দৈনন্দিন জীবনে সব সময়ে সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই বড় হয়ে সন্তানের কর্তব্য মা বাবাকে সংসারের কাজ কর্ম থেকে অব্যাহতি দেওয়া। মা-বাবা কিসে খুশি হন সে সম্বন্ধে চিন্তা করা। মা বাবার যত্নে স্নেহ-আদরে সন্তান বড় হয়। সে সন্তান যদি বড় হয়ে মা বাবাকে ভুলে যায় তাহলে মা বাবা খুব দুঃখ পান। বৃদ্ধ মা বাবা দাদা- দাদি, নানা-নানি অথবা বয়স্ক আত্নীয় স্বজনকে শ্রদ্ধা করা সবার কর্তব্য। এ কথা অল্প বয়স থেকে বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে হবে। মা বাবা যদি শ্বশুর শাশুড়িকে যত্ন করেন সন্তানও বড় হয়ে মা বাবার প্রতি মমতা অনুভব করবে এবং যত্ন করতে ভুলবে না।

মা-বাবা, দাদা-দাদিকে সংসার থেকে কিছুটা অবকাশ দেওয়ার কথা সন্তানকে মনে রাখতে হবে। মা-বাবাকে বেড়াতে যাবার জন্য উৎসাহী করতে হবে। কারণ বাইরের জগৎ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে। বৃদ্ধ বয়সে অনেক না পাওয়ার বেদনা মনে সঞ্চিত হয়। তাই বহির্জগতে ঘুরে বেড়ালে এবং অনেক মানুষের সাথে পরিচিত হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলে জীবন ও জগতকে অপরূপ মনে হবে। বয়স্কজনের প্রতি সেবার মনোভাব বাড়াতে হবে। মা বাবার জন্য কিছু করতে পারার মাঝেই সন্তানের জীবনের সার্থকতা, তাই মা বাবার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও মমতা এনে দেবে মা দিবস পালনের সফলতা ও আদর্শ চরিত্র গঠনের তাৎপর্য।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিতা ও গণদেবতা
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম