আমার দেশ আমার শহর

‘আলোয় ভুবন ভরা’

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | শুক্রবার , ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

পহেলা বৈশাখ বাঙালির জন্য আবেগঘন আনন্দের দিন। বছরের শেষ দিনটিতে বিদায়ের সুরে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সেসাথে পহেলা বৈশাখের আগমনের আনন্দবার্তায় বিষাদময় অন্তর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।

গত বছর নববর্ষের দিন কানাডার টরেন্টোতে ছিলাম। সেখানে প্রবাসী বাঙালিদের আয়োজিত বিশাল এক পার্কে নববর্ষ বরণের আয়োজন করা হয়েছিল। পার্কের সবুজ ঘাসে চরণ রাখতেই শুনতে পেয়েছিলাম “এসো হে বৈশাখ এসো, এসো”। দু’চোখে অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমিকে আমরা কি গভীরভাবে ভালোবাসি তা নববর্ষের অনুষ্ঠানে উপলব্ধি করেছিলাম। প্রবাসীরা সেদিন প্রায় সবাই সাদা লাল পোশাকে সজ্জিত ছিল। অনুষ্ঠানে নাচ, গান, কবিতা, আবৃত্তি বাংলাদেশের শিল্পীদের মত একে একে পরিবেশিত হয়েছিল। সেখানকার মেয়র উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনিও বাংলা গানের সুরে তালে তালে বাঙালিদের মত নাচ করেছিলেন। বাংলা নববর্ষের আনন্দঘন বার্তা বিদেশিদের অন্তরকেও অভিভূত করেছিল।

এ বছর ১৩ এপ্রিলের সুন্দর স্বর্ণালী বিকেলে চট্টগ্রাম একাডেমিতে ‘বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের’ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। ব্যানারে লেখা ছিল ‘আয়রে রৌদ্র, আয়রে আমার আলো/ আয়রে শান্তি আয়রে সকল ভালো’। “সুশ্রী, কমনীয়, মিষ্টভাষী, মায়াময়, প্রাণবন্ত অসাধারণ গুণী সবার প্রিয় বাচিক শিল্পী আয়েশা হক শিমুর পরিচালিত উঠোন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আয়োজিত বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান উপভোগ করার দুর্লভ সৌভাগ্যে সেদিন আমি আমোদিত হয়েছিলাম।

উঠোন’ শব্দটি অনেক তাৎপর্যময়। বাঙালির গ্রাম বাংলার প্রতিটি গৃহের সামনে একটি নাতিদীর্ঘ মসৃণ পরিচ্ছন্ন উঠোন রয়েছে। এক সময় বাড়ির সবার ও আশপাশের স্ত্রী পুরুষ অনেকের মিলনমেলার কেন্দ্র ছিল বাড়ির উঠোন। কখনো দেখা যেতো উঠোনের এক পাশে মাটির উনুনে গৃহিণী পিঠে পুলি তৈরি করছেন। শীতের নরম উষ্ণ রোদে তাঁর চারপাশে অনেকে বসে তা উপভোগ করছে। কখনো কৃষকের স্ত্রী ধান শুকাচ্ছেন। কখনো ঘরের নারীরা শীতল পাটি, পাখা তৈরি করছেন। কুমোররা মাটির তৈজসপত্র তৈরি করছেন। তাঁতীরা কাপড় বুনছেন অথবা অলস দুপুরে পুরুষদের উচ্চকিত কন্ঠের আলোচনায় উঠোন সরব হয়ে উঠতো। গ্রাম বাংলার উঠোন তাই দখিনা বাতাসে পুলকিত ও রোদেলা সকালে অথবা গৌধূলির স্নিগ্ধ আলোর আবহে পরিপূর্ণ শান্তির স্থান হিসেবে চিহ্নিত।

আয়েশা হক শিমুর সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ‘উঠোন’ গ্রাম বাংলার চিরায়ত উঠোনের মাধুর্যকে নাচে, গানে কবিতা আবৃত্তিতে, ছবি আঁকা ও কুটির শিল্পের সমাবেশে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। বহুতল ভবনের আড়ালে শহরের আয়োজনে গ্রাম বাংলার যে উঠোন হারিয়ে গিয়েছিল তা যেন শিক্ষার্থীদের অপরূপ বর্ণ বৈচিত্র্যে পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার মনের মুকুরে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যে ভরপুর উঠোনের স্মৃতি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।

শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করবে। কারণ লেখাপড়া হলো জ্ঞানের ভুবনে পৌঁছাবার সোপান। তাই লেখাপড়া করে শিশুরা শিক্ষিত হবে। কিন্তু প্রত্যেক শিশুর মাঝে রয়েছে অন্তর্নিহিত গুণাবলী। সেই অন্তর্নিহিত গুণাবলী বিকাশের জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকের আন্তরিকতা ও কর্মনিষ্ঠার প্রয়োজন। আয়েশা হক শিমুর পরিচালনায় অসংখ্য শিক্ষার্থীর সমাবেশে প্রতীয়মান হয় শিমুর সুদক্ষ কর্মকুশলতা ও মায়াময় অন্তরের প্রাচুর্য। আগেকার দিনে প্রায় বাঙালি অভিভাবক সন্তান খেলাধুলা করবে, নাচগান, কবিতা আবৃত্তি ও ছবি আঁকবে তা পছন্দ করতেন না। বাঙালির সৌভাগ্য আয়েশা হক শিমুর মত বাংলাদেশে কিছু সংস্কৃতিমনা মানুষের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ধীরে ধীরে একটি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ে উঠেছে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমি যখন মহিলা কলেজ চট্টগ্রামে ১৯৮৩ সালে যোগদান করেছিলাম তখন কলেজে প্রতি বছর শিক্ষা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও চট্টগ্রাম আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতা আমাদের কলেজে অনুষ্ঠিত হতো। অধ্যাপক পূর্ণিমা পালিত, অধ্যাপক সাধনা দত্ত ও আমি প্রধানত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতাম। বেশির ভাগ ছাত্রীরা নাচগান জানলেও নাচগানের চর্চা করতো না ও মাইকের সামনে কবিতা আবৃত্তি ও উপস্থাপনা করতে স্বচ্ছন্দবোধ করতো না। আমরা কখনো স্টেজের সামনে বসে ফাংশন দেখতাম না। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কার পরে কে অনুষ্ঠান করবে তা আমাদের দেখতে হতো। অনেক প্রতিযোগী নার্ভাস হয়ে যেতো তাদের সাহস যোগাতে আমাদের তাদের পাশে থাকতে হতো। তবে সৌভাগ্যের বিষয় আমাদের কলেজ থেকে প্রতি বছর জেলা পর্যায়ে ও বিভাগীয় পর্যায়ে ছাত্রীরা অনেকে পুরস্কার পেয়ে আমাদের কলেজকে গর্বিত করতো। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গুণাবলীর বিকাশ সাধন ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় যাঁরা স্বতঃস্ফূতভাবে করে থাকেন তাদের আন্তরিকতা কর্মনিষ্ঠা অতুলনীয়। ‘উঠোন’এর কর্ণধার আয়েশা হক শিমু এবং তার সহযোগীদের সবাই প্রশংসাধন্য। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী এতো চমৎকার নাচ, গান (তবলা বাদক পাঁচ/ছয় বছর বয়সীও রয়েছে) তবলা, কবিতা, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও কুটির শিল্প প্রদর্শন করেছে যা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। হাতে তৈরি পাখা ও ছবি এঁকে আমাদের যে উপহার দেয়া হয়েছে তা দুর্লভ নিদর্শন। নববর্ষ উৎসবের মূল লক্ষ্য বাঙালির ঐতিহ্যকে তুলে ধরা। ‘উঠোনে’র শিল্পীরা (অনেকে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত) তা সাফল্যের সাথে করেছে এবং সেজন্য অভিভাবক ও বিশেষ করে আয়েশা হক শিমুর কৃতিত্ব অসাধারণ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হেলেন কেলার একবার সাক্ষাৎকারের আলোচনায় বলেছেন দু’টি শব্দ তাঁদের দু’জনেরই খুব প্রিয়। তা হলো Light এবং Love। Light অর্থাৎ জ্ঞানের আলো যা চারপাশের ও মনের অন্ধকারকে দূর করার আলো, জগৎ ও জীবনকে উপলদ্ধি করার আলো। Love হলো মানুষকে ভালোবাসা, প্রকৃতি পরিবেশ ও প্রাণীদের ভালোবাসা, মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও পৃথিবীকে ভালোবাসা। তাই প্রকৃত মানুষ হতে হলে ‘আলো ও ভালোবাসা’ ছাড়া একজন শিক্ষার্থী সাফল্য অর্জন করতে পারলেও মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান লাভ করতে পারবে না।

আমার ছেলেমেয়েরা নাচ, গান, ছবি আঁকা ও কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করতো, অনেক সময় পুরস্কার পেয়েছে। আমার কন্যা অনিন্দিতাকে পাঁচ বছর বয়সে তার পিতা মুজিবুর রহমান হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রথম যে রবীন্দ্রসংগীতটি শিখিয়েছিল তা হলো ‘আলো আমার আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা’। ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম একাডেমিতে প্রবেশ করে হল ভর্তি ‘উঠোনে’র শিক্ষার্থীদের দেখে আমার মনে হলো সত্যি আলোয় ভুবন ভরা, যারা সংস্কৃতির চর্চা করে তাদের মনে লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, বিরাজ করে না। তারা ভালোবাসেন ফুল, লতাপাতা, সাগর অরণ্য পর্বত আকাশকে। আলোকিত মানুষ আয়েশা হক শিমু ও রাশেদ রউফের প্রচেষ্টায় ‘উঠোনের’ আলোর শিশুরা একদিন বড় হয়ে বাংলাদেশে নতুন পথ সৃষ্টি করবে। উজ্জ্বল আলোয়, মুক্ত বাতাসে আলোর পাখিরা লোভ হিংসার পরিবর্তে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষকে ভালোবাসতে শেখাবে। ‘উঠোন’ এর বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সবার এ প্রত্যাশা সফল হোক এ কামনা করি।

টীকা :সংস্কৃতি কখনো স্থবির নয়, তা প্রবহমান, নদীর মতই তা গতিময়’। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অক্ষয় হোক নববর্ষে এ আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসরায়েলি বর্বরতার শেষ কোথায়?
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা