আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেত আরিফা মুবাশশিরা | বৃহস্পতিবার , ১৩ জুন, ২০২৪ at ৮:২৯ পূর্বাহ্ণ

আমার বিদেশ ভ্রমণ করতে ভালো লাগে কিন্তু বিদেশে বসবাস করতে (দু’তিন মাসের জন্য হলেও) ভাল লাগে না। ছোট ছেলে আবীর কানাডায় থাকে। দু’বছর আগে ভিসার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার যেতে আগ্রহ হয় না। এ বছর মার্চ মাসে বউমা শায়লা মোনা (নর্থ সাইথ ইউনিভারসিটিতে লেকচারার ছিল) ও একমাত্র ছেলে চার বছরের নায়েলকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। তার উৎসাহে অবশেষে আমি তার সাথে কানাডা যেতে আগ্রহী হলাম। চার পাঁচদিনের প্রস্তুতিতে পরিচিতদের অনেককে না জানিয়ে কানাডায় চলে গিয়েছিলাম। মার্চ মাসে শেষ হতে চলেছে। বাংলাদেশে সে সময় বসন্তের মনোরম পরিবেশ। কিন্তু টরেন্টোতে প্রচন্ড শীত। কনকনে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা। আমার প্রথমেই আগ্রহ ছিল নায়াগ্রা ফলস দেখার। কৈশোর থেকেই স্বপ্ন ছিল নায়াগ্রা ফলস দেখার জন্য। ইংরেজি ছবিতে নায়াগ্রা ফলস অনেকবার দেখেছি। তবু কাছ থেকে বিশাল জলপ্রপাত দেখার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। অজস্রধারায় গড়িয়ে পড়ছে অনন্ত জলের স্রোত। দিনটি রোদ ঝলমলে ছিল। তবু বিকেলের পড়ন্ত আলোয় মেঘের আর কুয়াশার মাঝে জলের অফুরন্ত ধারার দৃশ্য। অনেক পর্যটকের ভীড়। রাতের আঁধারে রঙীন আলোর খেলা নায়াগ্রা ফলসকে আরও মনোহর করে তোলে। বিস্মিত নয়নে জলের সীমাহীন ফলগু ধারা অবলোকন করে যেন আমার কিছুতেই তৃপ্তি হচ্ছিল না।

১০এপ্রিল ছিল রমজানের ঈদ। মুজিবের বড় ভাই বিজ্ঞানী ড. শফিকুর রহমানের পুত্র নাঈমুল রহমান সপরিবারে টরেন্টোতে থাকে। সকালে ও দুপুরে তাদের বাসায় নিমন্ত্রণ। ঈদের দিন আবীর অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল। বিকেলে আমরা লেকের ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। টরেন্টোতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক লেক। আমরা সুন্দর একটি লেকের তীরে বেড়াতে গেলাম। শীতল বাতাসকে উপেক্ষা করে অনেক দর্শক সেখানে এসেছিলেন। ঈদের পোশাকে বোঝা যাচ্ছিল অনেকে ভারতীয় ও পাকিস্তানি মুসলমান পরিবার। একে অপরকে তাই ঈদ মুবারক বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন হলো। লেক থেকে কিছু দূরে আবাসিক এলাকা। মসৃণ রাস্তার দু’ধারে কটেজ টাইপের বাসা। মোনা বললো কটেজগুলো ধনী কোটিপতিদের বাসগৃহ। কিন্তু সেগুলোতে বিলাসিতার বাহুল্য নেই। পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নীল জলের ধারে রঙীন ফুলের মাঝে মনোরম সুদৃশ্য নীড়। হেঁটে লেকের পাশে যাবার সুব্যবস্থা। আমাদের দেশে কত নদী। প্রতিটি শহর ও গ্রামে নদী আছে। টরেন্টোর শ্যামলিমার পরিবেশের মতই বাংলাদেশের নদীর দুধারে সবুজ বৃক্ষের সমাহার। কিন্তু বৃষ্টি হলেই আমাদের দেশের নদীর দু’তীরের মাটি কেন সরে গিয়ে বাড়িঘর নদীর মাঝে হারিয়ে যায়? পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই নদীর দু’ধারে শক্ত পাথরের দেয়াল ও জলোচ্ছ্বাস না হবার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা কেন আমাদের রূপসী বাংলাকে মোহনীয় ও নিরাপদ করে তুলতে পারি না? সামান্য বৃষ্টিতে কেন শহর ও গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়? পতেঙ্গা বীচ অত্যন্ত সুন্দরভাবে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এখন অপরিকল্পিতভাবে তৈরি দোকানপাট, আবর্জনাময় পরিবেশ। প্রচন্ড কোলাহল। দু’দন্ড নিরিবিলি বসার সুযোগ নেই। শান্ত স্নিগ্ধ সুন্দর পরিবেশের টরেন্টো লেকের সৌন্দর্য অবগাহন করতে করতে দেশের কথা মনে করে আমি দুঃখ অনুভব করছিলাম।

১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ। নববর্ষে বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে আনন্দের রেশ। আমি মোনাকে বললাম, মোনা চলো বিদেশে বাংলা নববর্ষ কিভাবে উদযাপিত হয় দেখতে যাই। সবাই মিলে রওনা দিলাম। আবীরের বাসা থেকে বোধহয় দেড় ঘন্টার পথ। জায়গাটির নাম মনে নেই। বাংলাদেশের অনেক মানুষ সেখানে বসবাস করেন। বিশাল একটি মাঠে নববর্ষের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দূরে গাড়ি পার্ক করে আমরা সবাই হেঁটে এলাম। কাছে আসতেই শুনি “এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো” গান হচ্ছে। গানটি শুনেই আমার মন কেমন করে উঠলো। চোখে পানি এলো। আমি খুব আবেগপ্রবণ। বিদেশে বাংলা গানের সুর আমার প্রাণকে দেশপ্রেমে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। প্রায় সবাই সাদা লাল পোশাক পরে এসেছেন। মোনা আমাকে তার আম্মার লাল শাল পরিয়ে দিয়েছিল। আমি সেখানে বাঙালিদের সাথে মিলিত হয়ে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছিলাম। স্টেজে গান আলোচনা হচ্ছিল। সম্মানিত মেয়র এসেছিলেন। তিনিও স্টেজে অনেকের সাথে নাচ করলেন। শুভেচ্ছা বক্তৃতায় বললেন আগামী বছর তিনি সাদা লাল পোশাক পরে আসবেন। বিশাল মাঠের একপাশে বাংলাদেশের পণ্যে সজিত কয়েকটি ছোট্ট স্টল। অদূরে মাঠের একপাশে নাতিদীর্ঘ শহীদ মিনার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য কি অপরিসীম মায়ামমতা। সত্যি প্রবাসী বাঙালি ধন্য। বিকেলে আমরা দূরের রেস্তোরায় খেতে গেলাম। মাঠের কাছে বড় রাস্তার ধারে অনেকগুলো বাঙালি পরিচালিত বাংলাদেশি খাবারের রেস্তোরাঁ। সেগুলোতে ইলিশ পোলাও এবং বাঙালি খাবারের জন্য বাঙালিদের প্রচন্ড ভীড়। কোথাও বসার জায়গা নেই। বরং অনেকে প্রতীক্ষারত। মোনা তাই কতগুলো সিংগারা নিয়ে এলো। আলু কলিজার সিংগারা। যেন অমৃত। এতো চমৎকার স্বাদের সিংগারা আজকাল চট্টগ্রামের কোন হোটেলে নেই। চট্টগ্রামের বড় বড় হোটেল গুলোতে আলুর ভর্তার বিস্বাদ সিংগারা। গরম চা আর সিংগারা বাঙালির প্রিয় নাস্তা। এখন বাংলাদেশের দু’টোরই অভাব। কারণ গরুর খাঁটি দুধের চা আর আলু পিঁয়াজ কাঁচামরিচের অপূর্ব স্বাদের সিংগারা আজকাল চট্টগ্রামে দুর্লভ।

মার্চ মাসে টরেন্টোতে গিয়ে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। কারণ প্রকৃতিতে হাহ্‌কার। শীতে সব পাতা ঝরে রুক্ষ পরিবেশ। আমাদের দেশ কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অপূর্ব। চৈত্র মাসে পাতা ঝরতে না করতেই কচি সবুজ পাতায় গাছ শ্যামল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণচূড়া, শিমুল পলাশের শোভায় চারদিক অপূর্ব হয়ে ওঠে। কোন ঋতুতেই প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে ওঠে না। এপ্রিলের শেষে টরেন্টোর গাছগুলোতে নতুন পাতা দেখা দিচ্ছিল। মোনা বললো চলেন চেরি ফুল দেখে আসি। আমি উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলাম। পরদিনই কঅজওণঅ চঅজকএ গেলাম। একটি ছোট জলাশয়কে (গ্রামে একে পুকুর বলবে না, বলে ডোবা) কেন্দ্র করে বিভিন্ন রঙের চেরি এবং অন্যান্য রঙিন ফুল গাছের সমাহার। জলাশয়ে হাঁস সাঁতার কাটছে। কৃত্রিম পুল, পাথরের মূর্তি, সিমেন্টের বসার জন্য ব্যবস্থা, ভাবছিলাম ছোট জলাশয়কে ঘিরে এতো সুন্দর ব্যবস্থা। কত পর্যটকের ভীড়। আর আমাদের চট্টগ্রামের আসকার দিঘি, দেওয়ানজি পুকুর এসব কোথায় ? চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে কি কোন বড় মাঠ বা বড় দিঘি আছে? সবে ধন সিআরবি কে নিয়ে কত টানাটানি।

কানাডা যাবো শুনে ‘অনন্যধারা’ পত্রিকার সম্পাদক গল্পকার সুলেখক রুনা তাসমিনা বলেছিল ‘আপা ম্যাপল ট্রি দেখবেন’। কিন্তু টরেন্টোতে এসে প্রথমে ম্যাপল ট্রি খুঁজে পাই না। কারণ কোন বড় গাছে (ক্রীসমাস ট্রি ছাড়া) পাতা নেই। অবশেষে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আবীর একদিন বললো আমার নাতি নায়েলের স্কুলের কাছে বিশাল সবুজ এলাকায় রাস্তার পাশে সারি সারি ম্যাপল ট্রি ও অনেক রঙিন ফুলের গাছ। পরদিন আমি আর মোনা উপস্থিত হলাম। অপূর্ব দৃশ্য। উজ্জ্বল মেরুন রঙের পাতার সমাহারে ম্যাপল ট্রি। নানা রঙের পাতার ম্যাপল ট্রি পরে টরেন্টোর বিভিন্ন স্থানে দেখেছিলাম। কিন্তু সেদিন প্রথম অপূর্ব মেরুন রঙের পাতায় সৃমদ্ধ সারিবদ্ধ ম্যাপল ট্রি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ম্যাপল ট্রির পাতায় বিশেষত্ব রয়েছে। কানাডার জাতীয় পতাকায় এর ছবি রয়েছে। ম্যাপল ট্রি থেকে সিরাপ, গুড়, লজেন্স ইত্যাদি তৈরি হয়। আমাদের দেশের খেজুর গাছের কথা মনে পড়ে যায়।

টরেন্টো থেকে প্লেনে (৪ঘন্টা লাগে) এপ্রিল মাসের শেষে মেক্সিকো গিয়েছিলাম। সেখানে মেক্সিকোর CANCUN বীচের পাশে হোটেলে তিন/চার দিন ছিলাম। সমুদ্রের পানি নীলসবুজ। সকালে নীল, দুপুরে সবুজ, বিকেলে সবুজ নীল সন্ধ্যায় ধূসর পানি। অনন্য সাধারণ মনোরম দৃশ্য, হোটেলের বারান্দার বসে সকালে সূর্যোদয় দেখা যায়। সমুদ্রের পাশে বালির সরু রাস্তা। হোটেল থেকে দু’মিনিটে হেঁটে সাগরের তীরে যাওয়া যায়। সমুদ্রের পাশে পরিকল্পিতভাবে হোটেলগুলো তৈরি। হোটেলের সামনে শক্ত দেওয়াল। ভেতরে উঠানে সমুদ্র উপভোগ করার জন্য ও উপাদেয় খাবার গ্রহণের জন্য মনোরম ভাবে ছনের ছাউনি (আমাদের দেশের গ্রামের কুড়েঁঘরের ছাদ হিসেবে একসময় ছাউনি ব্যবহৃত হতো) দিয়ে তৈরি বসার ব্যবস্থা। অদূরে সুইমিং পুল। সবই সাগরের কাছাকাছি। ওখানে কি সাইক্লোন হয় না? জলোচ্ছ্বাস হয় না? আমার মনে হয় এমন জায়গায় হোটেলগুলো তৈরি করা হয়েছে যেখানে হয়তো তেমন জলোচ্ছ্বাসে হোটেলগুলো প্লাবিত হয় না। অথচ সাগরের সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নান্দনিক অপূর্ব মোহনীয় পরিবেশ। ইচ্ছে করে ঘন্টার পর ঘন্টা সমুদ্রতীরে বসে থাকি। বিদেশিরা তো সুইমিং পুল আর সাগরের পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটছে। গোসল করছে আর ফটো তুলছে। আশিনব্বই দশকেও কক্সবাজারের পরিবেশ চমৎকার ছিল। এখন কক্সবাজারে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন শোনা যায় না। যানজট, কলবর, নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ধুলোময় আবহাওয়া অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হোটেল ফ্ল্যাটের সমাবেশে কক্সবাজার জরাজীর্ণ। আমি তো কদাচিৎ বিদেশে যাই। যারা অহরহ সরকারি টাকায় বিদেশে ভ্রমণে করেন তাদের কি দুঃখ লাগে না বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে লোপ পাচ্ছে, সৌন্দর্য কিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। তা উপলব্ধি করে!

নায়াগ্রা ফলস দেখে ভেবেছিলাম, আহা আমাদের দেশে যদি নায়াগ্রা ফলস থাকতো, তবে পর্যটকদের ভীড় হতো। ডলার উপার্জিত হতো। বাংলাদেশিরা অপূর্ব জলপ্রবাহ উপভোগ করতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশে এসে ভাবছি ভাগ্যিস বাংলাদেশে নায়াগ্রা ফলস নেই। থাকলে কি সেরকম সুন্দর রাখা যেতো। ময়লা আবর্জনা, কলকারখানার দুষিত পদার্থ ফেলে বুড়িগঙ্গা নদীর মতই নায়াগ্রা ফলসকে অপরিচ্ছন্ন নোংরা কালো পানিতে ভরপুর করে তোলা হতো। পর্যটকদের দাঁড়াবার জায়গায় বাদামের খোসা, চীপসের প্যাকেট, ছেঁড়া নোংরা কাগজ, খাবারের আবর্জনা আরও কত কি? সত্যি পরম করুণাময় যা করেন তা মানুষের ভালোর জন্যই করেন !

টীকা : যত অসুবিধা থাকুক না কেন তবু দেশে ফিরে এলে মনে হয় “ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা”।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএল.এ. চৌধুরী : আদর্শ মানুষ, আদর্শ পিতা
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল