ড. মাহবুবুল হক অনেক কাজ করেছেন। গবেষণা ও সম্পাদনায় তাঁর বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। এই কাজসমূহের ভেতরেই তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি অনেক বেশি স্বচ্ছ। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রতিশ্রুতিশীল মানুষ ছিলেন। মাহবুব ভাইয়ের অনেক ধরণের সাংগঠনিক কর্ম রয়েছে। জীবনের শুরুতেই ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। ১৯৭৭–৭৮ সালে উনি যখন রাঙ্গুনিয়া কলেজের শিক্ষক অরিন্দম–এর ‘রাইফেল’ নাটকের প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন কলেজের সাংস্কৃতিক উৎসবে। অমিত চন্দের মাধ্যমেই প্রথম আমি পরিচিত হই মাহবুব ভাইয়ের সাথে। সম্ভবত ১৯৭৮–৭৯ সালে তিনি একটি থিয়েটার কর্মশালা পরিচালনায় ভূমিকাও রেখেছিলেন। সাংস্কৃতিককর্মী বিশ্বনাথ চৌধুরী বিশু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক সংসদের আয়োজনে তা পরিচালিত হচ্ছিল। সেই সময়ে নাটক নিয়ে তাঁকে আগ্রহী হতে দেখেছিলাম। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের ফোকলোর নিয়ে আগ্রহী হয়েছেন, অনেক কাজও করেছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি শামসুল হোসাইনের সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ‘লোক সংস্কৃতি পরিষদ’। পরবর্তীতে ‘সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি’ (২০০৮) নামে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
কথাকলি–এর মতো বইয়ের প্রতিষ্ঠানের সূচনাও হয় তাঁর হাত ধরে। সেখানে প্রায় নিয়মিত দেখা হতো। তারপর থেকে প্রায় প্রায় নানা কিছুতেই মাহবুব ভাই ছিলেন আমাদের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য একজন মানুষ। ১৯৯১ সালে উমরতুল ফজলকে সভানেত্রী ও মাহবুব ভাইকে সাধারণ সম্পাদক করে আমরা অনেকেই মিলিত হয়ে তাঁর নেতৃত্বে একটা বড় কাজ করেছিলাম, আর তা হলো ‘জাতীয় সম্প্রীতি সম্মিলন’। এই সম্মিলন পরিষদ প্রায় পুরো ৯০ দশকেই একটা বড় প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছিল। যার প্রধান লক্ষ্য ছিলো মানবিক ঐক্যের চেতনা গড়ে তোলা। এই সম্মিলনের যে–ঘোষণাপত্র তৈরি হয়েছিল তার একটি কপি এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে যা আজও অত্যন্ত সমসাময়িক ও প্রাসঙ্গিক। ঘোষণাপত্রের প্রথম খসড়াটিও করেছিলেন মাহবুব ভাই। সেদিন জাতীয় পর্যায়ের অনেক গুণী মানুষকে যুক্ত করা হয়েছিল। ১ ও ২ নভেম্বর ১৯৯১ সালে মুসলিম হল ও লালদীঘি ময়দানে একই সাথে উদ্যাপিত হয়েছিল এই সম্প্রীতি সম্মিলন। দেশবরেণ্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধীজীবীদের উপস্থিতিতে এতবড় আয়োজন বাংলাদেশে আর কখনো অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়নি এবং এটা চট্টগ্রামেই করা হয়েছিল।
বিটার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই মাহবুবুল হক নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিশুদের বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতেন। এই চমৎকার পরিবেশনা অনেকটাই ছিলো ছাত্র–শিক্ষকের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নির্মাণের এক উজ্জ্বল উপস্থাপনা যা এখনো অনেক বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়। বিটা থেকে প্রকাশিত ‘লোকবাদক বিনয় বাঁশী’ গ্রন্থের ভূমিকায় মাহবুবুল হকের পর্যবেক্ষণ কিছুটা তুলে দিলাম আজকের পাঠকের জন্য।
“গ্রাম বাংলার আনাচে–কানাচে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে লোক–সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করে গেছেন যাঁরা তাঁদেরই একজন লোকবাদক বিনয় বাঁশী জলদাস। মাটি ও মানুষের সত্যিকারের শিল্পী বলে যাঁদের চিনে নেওয়া যায় বিনয় বাঁশী তাঁদেরই একজন।
বিনয় বাঁশী জন্মেছিলেন জেলে পরিবারে। প্রান্তিক সমাজের অধিবাসী এই জেলেরা আবহমান কাল ধরে বিবেচিত হয়ে আসছেন অন্ত্যজ সম্প্রদায় হিসেবে– কখনো বা অস্পৃশ্য জ্ঞানে। মৎস্যশিকারী পরিবারের সন্তান হিসেবে বিনয় বাঁশীর বংশ পদবি ‘জলদাস’, অর্থাৎ জলের দাস; কিংবা ভিন্নার্থে ‘জলপুত্র’। এই জলপুত্র কীভাবে লোকবাদক হলেন সেই কাহিনীকেই চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অধ্যাপক–গবেষক হরিশংকর জলদাস এই গ্রন্থে। যে দেশে অশিক্ষা, গোত্রীয় নিগড়, হীনম্মন্যতা ইত্যাদি সামাজিক পশ্চাদ্পদতা দারিদ্রপীড়িত ও শোষিত জেলে সম্প্রদায়ের নিত্যসঙ্গী, সে দেশে এই সব প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে বিনয় বাঁশী উঠে এসেছিলেন মহৎজনের সারিতে। সেই কাহিনীই উপন্যাসোগম আঙ্গিকে অনবদ্য ভাষায় আমাদের শুনিয়েছেন হরিশংকর।
নানা টানাপোড়নে ধীবর–সন্তান বিনয় বাঁশীর জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখার সুযোগ তেমন হয়নি। কিন্তু জীবনের পাঠ তিনি নিয়েছিলেন প্রকৃতি, প্রাকৃত জনগণ ও পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকে। জীবনের একটা পর্যায়ে সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন কিছু প্রকৃত মানুষের সাহচর্যে এসেছিলেন তিনি। তাঁদের কাছ থেকেও মানব জীবনের মহৎ কিছু পাঠ তিনি পেয়েছেন। এই সব মানুষের মধ্যে আছেন কমরেড অমর সেন, কবিয়াল রমেশ শীল, কবিয়াল ফণী বড়ুয়া, কবিয়াল রাইগোপাল দাশ প্রমুখ। আরও পরে তরুণ প্রজন্মের কিছু সৎ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তিনি সিক্ত ও প্রীত হয়েছেন– এঁদের মধ্যে আছেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও বিটা সহ বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার নেতা, সংগঠক ও পরিচালকরা।”
মাহবুব ভাই কোনো সভায় কিংবা আলোচনায় কখনো প্রস্তুতি না নিয়ে যেতেন না এবং অনুষ্ঠানে অন্যরা যা বলতেন তিনি অনায়াসে তা লিপিবদ্ধ রাখতেন। এরকম অনেক নোটকে তিনি সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখতেন। ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ (২০১০) শীর্ষক বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইটি নজরুলের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ গবেষণায় হয়তো আগামী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে। বইটি নিয়ে পবিত্র সরকার বলেছেন “নজরুল–চর্চায় একটি অতিশয় মূল্যবান সংযোজন বলেই মনে করি। বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নজরুল–গবেষকগণ এ গ্রন্থটিকে পরম সমাদরে গ্রহণ করবেন এবং লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করবেন–এ আশা অতিরিক্ত কিছু নয়।”
মাহবুবুল হক একাধারে প্রবন্ধ গবেষণা অভিধান ইত্যাদির পাশাপাশি অনুবাদ ও সম্পাদনায় অনেক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। এর বাইরেও শিশু–কিশোর গ্রন্থ, পাঠ্য সংকলন (বিভিন্ন ক্লাসের জন্য) রচনা করেছেন। তবে ব্যাকরণ নিয়ে তাঁর কাজ প্রণিধানযোগ্য। বাংলা ভাষা ও শুদ্ধ বাংলা লেখার ক্ষেত্রে তাঁর এই ভূমিকা বাংলাভাষী মানুষদের কাছে ড. মাহবুবুল হককে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। মাহবুব ভাইয়ের প্রতি জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।