তলাবিহীন ঝুঁড়ি দেশটি আজ সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশের পথে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে তাতে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের লক্ষ্য হলো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। গতবছর ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন হয়েছে। এবার উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনস্থ ৯টি দপ্তর/সংস্থার প্রধানদের নেতৃত্বে এই ভিশনের আওতায় ১৯৭টি উদ্যোগ চিহ্নিত করে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ বিনির্মাণের লক্ষ্যে স্মাট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট গভর্নমেন্ট ৪টি স্তম্ভের আলোকে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে অটোমেটেড করার জন্য এবং আগামী দিনের ‘স্মার্ট আইসিটি ডিভিশন’ নির্মাণের লক্ষ্যে ১৭৬টি সফট্ওয়্যার চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সম্পন্ন করা হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ আর স্বপ্ন নয় সেটি আজ বাস্তব। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামীলীগ সরকারের নতুন লক্ষ্য হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার। ইতিমধ্যে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের নাম পরিবর্তন করে ‘স্মার্ট টাস্কফোর্স’ গঠন করেছেন।
বর্তমানে ‘আমার গ্রাম– আমার শহর’ এই নামে দেশের সকল গ্রামে নাগরিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে সরকার। ইউরোপ–আমেরিকার আদলে দেশের গ্রামগুলোকে গড়ে তুলতে সরকারের ২০টি মন্ত্রণালয়ের ২৬টি সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ২৪৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার সমম্বয়কারী হিসেবে কাজ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার উদ্ভাবনী ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য অত্যাধুনিক পাওয়ার গ্রিড, গ্রিন ইকনোমি, দক্ষতা উন্নয়ন, ফ্রিল্যান্সিং পেশাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় দুই লাখ বিদ্যালয়, ভূমি অফিস, হেল্থ কমপ্লেক্সকে ফাইবার অপটিকের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেবা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর।
৪ দশকি ৭ একক জায়গার উপর নির্মিত ও স্থাপনা ডিজিটাল বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এ রূপান্তরের একটি নতুন ধাপ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের আওতায় বাংলাদেশ নলেজ ডেভলপমেন্ট পার্ক তৈরির কাজ চলছে।
কেমন হবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বপ্নের পরিকল্পনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’? ২০৩১ সলের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও উচ্চ–মধ্যবিত্ত আয় নিশ্চিতকরণ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ জ্ঞানভিত্তিক, উচ্চ অর্থনীতির উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রূপান্তরের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ ডলারে। গড়ে উঠবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
ধাপে ধাপে ২০২৫, ২০৩১ এবং ২০৪১ সালকে লক্ষ্য করে প্রয়োজনীয় ইমাজিং ফ্রন্টিয়ার কিংবা ফিউচার টেকনোলজিতে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ, ট্রাস্কফোর্স’।
এ মহাপরিকল্পনায় ডিজিটাল কানেক্টটিভিটি হবে পরবর্তী উন্নয়নের মহাসড়ক। এই মহাসড়ক ছাড়াও স্মার্ট সিটি বা স্মার্ট টেকনোলজি কোনোটাই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বিনির্মাণে স্বাস্থ্য সেবা, কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে আমাদের ফাইভজি কালেক্টডিটির সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে। সে আলোকে ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী বাংলাদেশ।
স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ক্লাইডে থাকবে সব ডিজিটাল সেবা। এটি বাস্তবায়ন করতে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ডাটা নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল সার্ভিস আইন, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি (শিফট) আইন, ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিওরশিপ অ্যাকাডেমি (আইডিয়া) আইন, এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজন (আকাশ) আইন, ডিজিটাল লিডারশিপ অক্যাডেমি আইন ও জাতীয় স্টার্টআপ পলিসি প্রণয়ন। বর্ণিত আইনগুলো বাস্তবায়ন করবে লেজিসথেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ এবং তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ। শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রম নিশ্চিতে ‘ওপন স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম এর আওতায় শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এর তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ।
স্মার্ট ও সর্বত্র বিরাজমান সরকার গড়ে তুলতে ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি বাস্তবায়ন করবে তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ। ক্ষুদ্র, কুটির. ছোট, মাঝারি ব্যবসাগুলো জিডিপিতে অবদান বাড়াতে এন্টারপ্রাইজভিত্তিক ব্যবসাগুলোকে বিনিয়োগ উপযোগী স্ট্যার্টআপ হিসেবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ বাস্তবায়নে রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ। অল্টারনেটিভ স্কুল ফর স্ট্যার্টআপ এ ডুক্টের অব টুমরো (এসেট) প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বাস্তবায়ন করবে। বাংলাদেশ নলেজ ডেভেলপমেন্ট পার্ক নির্মাণ ও পরিচালনা বাস্তবায়নে থাকছে হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এজেন্সি ফর নলেজ অন অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড স্পেস হরাইজান (আকাশ) প্রতিষ্ঠা, বাস্তবায়নে রয়েছে তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ। সেলফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এন্ট্রারপ্রেনিওরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিভ) প্ল্যাটফরম স্থাপন বাস্তবায়ন করবে হাই–টেক কর্তৃপক্ষ। কনটেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ্অ্যান্ড লিংকেজ ল্যাব (সেল) স্থাপনের দায়িত্বে থাকবে তথ্য প্রযুক্তি অধিদপ্তর। সার্ভিস এগ্রিগেটর ট্রেনিং (স্যাট) মডেলে সরকারি সেবা ও অবকাঠামো নির্ভর উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল।
বর্ণিত বিষয়াবলী পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় সরকার ২০৪১ সালকে সামনে রেখে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নির্মাণের মহাপকিল্পনা হাতে নিয়েছে। যা বাস্তবায়নে সরকার সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কাজ করছে।
সরকারের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ এবং স্মার্ট জনশক্তি। সারাবিশ্ব বর্তমানে কোভিড–১৯ পরবর্তীতে ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধজনিত কারণে অর্থনীতিভাবে হুমকির মধ্যে রয়েছে। সারাবিশ্বে চলমান খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের গতিপ্রকৃতি মূল্য বাড়া–কমা নির্ভর করছে রাশিয়া–্ইউক্রেন যুদ্ধের স্থায়িত্বের উপর। চলমান এ যুদ্ধ কেবল খাদ্য, জ্বালানি, ও পণ্য সরবরা্হকেই সংকটে ফেলেনি, কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করেছে। সংকুচিত হচ্ছে মানুষের কাজের ক্ষেত্র। বিশ্বব্যাপী চলমান এ দুর্যোগের সমাপ্তি নির্ভর করছে যুদ্ধের সমাধান তথা স্থায়িত্বের উপর। জাতি সংঘ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপেও এমন আশাংকার তথ্য দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা ফুড এ্যান্ড এগ্রিকালচার অগ্রাইনেজশন বলছে, দুর্ভিক্ষ আসন্ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আবহাওয়া পরিবর্তনের ভিন্ন রূপ হিসেবে দুর্যোগ বন্যা, খরা বেড়ে চলেছে।
যুদ্ধের প্রভাবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ডলার সংকট, জ্বালানির উচ্চমূল্য, মূল্যস্পীতি, খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ ও করোনা পরিস্থিতি দেশ এবং মানুষকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের শিল্পের উৎপাদন খাতে কোনভাবে বন্ধ না হয় সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। শিল্পে উৎপাদন চলমান রাখতে হলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। আমি আগেও বলেছি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের জন্য স্মার্ট জনশক্তি প্রয়োজন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ প্রয়োজন।” আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সরকারের প্রতি পদে পদে সুযোগ সন্ধানি ও পদলোভিরা সরকারের পরিকল্পনা এবং অগ্রগতির কে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
পত্রপত্রিকায় মিথ্যা তথ্য এবং সংবাদের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নের অংশিদার কর্মকর্তা–কর্মচারীদেরকে নিয়মিতভাবে কলংকিত করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। হাইব্রিডদের হাতে জিন্মি। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নিরপেক্ষ ও সততার দৃষ্টিকোণে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। সরকারে রন্দ্রে রন্দ্রে লুকিয়ে থাকা বিষবৃক্ষগুলোকে সনাক্ত করা এখন খুবই জরুরী।
২০৪১ এর মহাপরিকল্পনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নির্মাণে অবশ্যই আমাদের দেশে ‘স্মার্ট মানুষ’ তৈরি হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হবে। স্বপ্নের ‘স্মার্ট জনশক্তি’ গড়ে তোলার জন্য প্রাইমারী পর্যায়ের শিক্ষকদের উপর্যুক্ত প্রশিক্ষণ জরুরী। রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যৌথ সমন্বয়ে নিয়মিত নৈতিকতা ভিত্তিক ‘মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং’ এর ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত নৈতিকতা জন্ম দেয় সৃষ্টিশীল চিন্তাকে। সৃষ্টিশীল চিন্তা জন্ম দেয় জ্ঞানকে। জ্ঞান জন্ম দেয় শিক্ষাকে। শিক্ষা জন্ম দেয় সভ্যতাকে। সভ্যতা সুরক্ষা দেয় মানুষের অস্তিত্বকে।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী