লালদিঘির পাড়ের পশ্চিম দিকের ফুটপাতে পত্রিকার হকার বসত। তার কাছে দুনিয়ার পত্রিকা, ম্যাগাজিন ছিল। উল্টে–পাল্টে দেখেছি। কখনও কিনেছি। কখনও কিনিনি। ব্যতিক্রম ছিল একজন মানুষ। লম্বা–চওড়া। স্বাস্থ্য ভালো। ফর্সা। বড় বড় চোখ। চুলগুলো পেছনে উল্টিয়ে আঁচড়ানো। মুখে চুরুট। পান খেয়ে ঠোঁট দু’খানা লাল করে ফেলেন। পাজামা–পাঞ্জাবি ছাড়া কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সাধারণের চাইতে একেবারে আলাদা। কখনও আসেন গাড়িতে। কখনও রিকসায়। ভদ্রলোক আসার সঙ্গে সঙ্গে হকার যা যা আছে সব পত্রিকা আর ম্যাগাজিনের একটা করে কপি গুছিয়ে নিয়ে ভদ্রলোকের হাতে তুলে দেন। তিনি টাকা শোধ করে তাঁর গন্তব্যে চলে যান। একবার নয়। আমি এ দৃশ্য অনেকদিন দেখেছি। তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হয় জুবিলী রোডে কারেন্ট বুক সেন্টারে। তিনি গেলে দোকানের লোকজন ব্যস্ত হয়ে যেত। টুলি–চেয়ার হাতের কাছে যা পায় বসার জন্য এগিয়ে দেয়। তারপর সেলসম্যান অনেক মোটা একটা খাম বের করে আনে। ওখানে দেশ–বিদেশের হাজার জাতের ম্যাগাজিন। এক সঙ্গে পনের–বিশটা হবে। বের করে দিল। মূল্য পরিশোধ করে কিছু সময় বসেন। তারপর বেরিয়ে যান। ওখানেও তার সঙ্গে দেখা হতো। এক সময় পরিচয় হয়। কম কথা বলেন। ভারী গলায় কথা বলতেন। লোকটার নাম জহিরুল ইসলাম ছুট্টু। ছুট্টু সাহেব নামে তিনি পরিচিত। রঙ্গম সিনেমার মালিক। শহর চট্টগ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান।
ছুট্টু সাহেবের মতো আরেকজন মানুষের ছবি দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। তিনি রাজনীতিবিদ শহীদুল্লাহ। ন্যাপের শহীদুল্লাহ নামে চট্টগ্রামে পরিচিত। বিশাল দেহধারী মানুষ। ওজন দেড়শ –দু’শ কেজির কম হবে না। বেশিও হতে পারে। অকৃতদার। উনাকে কোনোদিন হাঁটতে কেউ দেখেনি। রিকশায় চলাচল করেন। পথসভায় রিকশায় বসে বক্তৃতা দেন।
কেন জানি না, জহিরুল ইসলাম ছুট্ট,ু ন্যাপের শহীদুল্লাহ, চট্টলবিদ গবেষক আবদুল হক চৌধুরীকে দেখলে আলাদা ধরনের মানুষ মনে হতো। এরা সারা চট্টগ্রামের অন্য সব মানুষের চেয়ে পৃথক। আজও চোখে ভাসে তাঁদের অবয়ব। মানুষগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মনে প্রশ্ন জাগে, কারা ছিলেন আমাদের আদিপুরুষ? কেমন ছিলেন তাঁরা? দু’হাজার কিংবা এক হাজার বছর আগে কে গোড়া পত্তন করেছিলেন এ নগরের? চট্টগ্রামের প্রথম বাসিন্দাটা কে? কে প্রথম বসতি স্থাপন করতে এ জনপদে আসে? ১৮৮৬ সালে সীতাকুণ্ড পাহাড়ে এ জনপদের প্রাগৈতিহাসিক যুগের নির্দশন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব নির্দশন নব্য প্রস্তর যুগের। আশ্মীভূত কাষ্ঠের তৈরি হাতিয়ার, কৃপাণ ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এসব নির্দশন ব্রিটিশ মিউজিয়াম, কলকাতা মিউজিয়াম, ঢাকা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। আবিষ্কৃত এসব নির্দশন পরীক্ষা–নীরিক্ষা করে গবেষকগণ বলেছেন, আট থেকে দশ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আরবের গোল মাথা বিশিষ্ট জনগোষ্ঠী চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। গবেষকরা বলেছেন, অস্ট্রো–এশীয় অর্থাৎ অস্ট্রিকগোত্রীয় মানুষেরা চট্টগ্রাম ও তার সংলগ্ন আরাকানের খ্রীষ্টপূর্ব যুগের আদি অধিবাসী। তাহলেই এরা সেই গোল মাথা বিশিষ্ট জনগোষ্ঠী! আমাদের সেই আদিমতম পূর্ব–পুরুষ। খ্রীষ্টপূর্ব যুগেও এজনপদে মানুষ ছিল! না অবিশ্বাস করি কী করে? যখন শুনি, খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর ছিল। সমুদ্র বন্দর মানেই তো জনবসতি। আমরা চট্টগ্রামের মানুষেরা অস্টিক গোত্রীয় মানুষের উত্তর পুরুষ। বলা হয়ে থাকে, প্রায় পাঁচ–ছয় হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রিক জাতি ইন্দোচীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করে। বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক।
আর্যদের আগমনের ফলে ধীরে ধীরে অস্ট্রিক ভাষা হারিয়ে যেতে থাকে। বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়। তাহলে আর্যরাও এখানে বসবাস করেছে। কবি, সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এরপরে বাঙালির শরীরে মেশে আরো একটি রক্ত ধারা; এদের বলা হয় ইন্দো–আর্য। আর্যরা ছিলো সুদেহী, গায়ের রঙ গৌর, আকারে দীর্ঘ, আর তাদের নাক বেশ তীক্ষ্ন। অনেক বাঙালির মধ্যে এদের বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়ে।’ এখানে এসেছে ভোট–চীনা জনগণও। তারা এসেছে কুমিল্লা নোয়াখালি হয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এসেছে কুকি–চীনারা। একারণে আমরা ইংরেজদের মতো সাদা ফর্সা না। আবার নিগ্রোদের মতো কালো না। কবি, সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ ভাষায় যদি বলি, ‘আমরা, তুমি, আমি এবং সবাই আকারে হয়ে থাকি মাঝারি রকমের। আমাদের মাথার আকৃতি না লম্বা না–গোল, আমাদের নাকগুলো তীক্ষ্ণও নয়। আবার ভোঁতাও নয়, এর মাঝামাঝি। উচ্চতায় আমাদের অধিকাংশই পাঁচ ফুটের ওপরে আর ছ–ফুটের নিচে।’
শহর চট্টগ্রামের ‘চারিদিকে তাকালে এটা সহজে বোঝা যায়। আমাদের পূর্বপুরুষ কারা; আমরা কাদের বিবর্তনের পরিণতি? আমরা একদিনে আজকের এ ছোটোখাটো আকার, শ্যামল গায়ের রঙ লাভ করিনি। আমাদের পূর্ব পুরুষ রয়েছে।’
১৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের প্রথম রাজা মাগধী চন্দ্র সূর্য চট্টগ্রাম আক্রমণ করেন। তাঁর সৈন্যদলের মধ্যে অনেক হিন্দু–বৌদ্ধ ছিল। তাঁদের সঙ্গে চট্টগ্রামের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে অনেক হিন্দু–বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। এসব হলো সাধারণত নিম্নবর্গের জনগোষ্ঠী। এছাড়া কায়স্থ, বৈদ্য এবং ব্রাক্ষ্মণরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন।
খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে আরব বণিকরা এ জনপদে ব্যবসা–বাণিজ্যের উদ্দেশে এসে বসতি স্থাপন করেন। এছাড়াও প্রচলিত ধারণাও বিদ্যমান। এমতে বলা হয়ে থাকে, এখানে আরব্য নাবিক, ফকির, দরবেশ, গৌড়ের তুর্কী পাঠান, বাদশারা এখানে নানা সময়ে বসিত স্থাপন করেছেন। এঁদের সঙ্গে চট্টগ্রামের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে চট্টগ্রামে মুসলমান জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। মুসলমানদের গৌড় বিজয়ের কিছুকাল পর বারো জন আউলিয়া চট্টগ্রামে আসেন। তার মধ্যে দশজনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন– সুলতান বায়জিদ বোস্তামী, শেখ ফরিদ, বদর আউলিয়া, কাতল পীর, শাহ মুহসিন আউলিয়া, শাহ পীর, শাহ উমর, শাহ বাদল, শাহ চান্দ। চট্টগ্রাম তখন অনেক পরীর চারণভূমি ছিল বলে লোকের ধারণা। কেউ কেউ চট্টগ্রামকে বলত ‘কয়রা পরীর দ্বীপ’। বারো আউলিয়া পরীদের দূর করার জন্যে এখানকার একটি পাহাড়ে আলো জ্বেলে রাখতেন। সেই পাহাড় এখন ‘চেরাগী পাহাড়’ নামে পরিচিত। চেরাগী পাহাড় এখনও আছে। ওর সামনে গেলেও মনে পড়ে আমাদের সেসব পূর্বপুরুষের কথা। আমরা হয়তবা তাদের উত্তরসূরি। আজকের চেরাগী পাহাড় অতীতে তেমন ছিল না। এটি প্রাচীনকালে বর্তমানের ডিসি হিলেরই অংশ ছিল। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের জামাল খান ও মোমিন রোডের সংযোগস্থলে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মারকস্তম্ভটি অতীতের সেসব পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ৫৪ ফুট উঁচু এবং নিচের দিকে ৪৬ মিটার ব্যাসের এই স্মারকস্তম্ভটি ১৬টি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভটির শীর্ষে মিনার, নিচে বাগান এবং ভেতরে সিঁড়ি রয়েছে। স্মারকস্তম্ভটি দেখতে অনেকটা চেরাগ আকৃতির।
ষোল–সতের শতকে পর্তুগীজ বণিকরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের মাধ্যমে একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এরা মেটে ফিরিঙ্গি নামে পরিচিতি লাভ করে। আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামে ‘ফিরিঙ্গি বাজার’ নামে একটি এলাকা আছে। চট্টগ্রামের কেউ কেউ আদর করে বলে ফেরাই বাজার।
একটা সময় ছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা শহরে বসবাস করাকে পছন্দ করতেন না। তাঁরা এটা খুব নিন্দনীয় কাজ মনে করতেন। হয়ত আজকের প্রজন্ম হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়বে। হয়ত দাদা–নানিদের প্রশ্ন করলে জানতে পারবে। তখন জমিদাররা শহরে একটা বাসা রাখতেন। আজকের দিনে যাকে আমরা বলতে পারি, রেস্টহাউজ। জমিদারদের আত্মীয় স্বজন কিংবা পাড়া–প্রতিবেশিরা শহরে কোনো কাজে কর্মে আসলে ঐ বাসায় উঠতেন। কাজ–কর্ম শেষ করে আবার গ্রামে চলে যেতেন। এখনকার প্রজন্মের অনেকেই আছো, কোনোদিন গ্রামে যাওনি। ঠিক তেমনি, সে সময়ের আমাদের অনেক পূর্বপুরুষ আছেন, যারা কোনোদিন শহরমুখো হননি। শহর দেখেননি। তখন জমিদাররা যে স্থানে বাস করতেন পরবর্তীকালে শহরের সেসব এলাকার নাম তাঁদের নামানুসারে হয়। যেমন পরইপারার দেওয়ান বৈদ্যনাথের বাসা ছিল আজকের দেওয়ান বাজারে। চন্দ্রনপুরায় বাসা ছিল চন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর। জামালখানে বাসা ছিল জামাল খাঁ, ফজর আলী খাঁ প্রমুখের। আজকের আছদগঞ্জে বাসা করেছিলেন আছদ আলী খাঁ। এয়াকুব নগরের নাম হয়েছে এয়াকুব দোভাষের নামে। এখানে এখনও তাঁর উত্তর পুরুষদের বসবাস বেশি। আন্দরকিল্লা, সদরঘাট, নালাপাড়া, গোল পাহাড় এলাকায় বিদেশীরা বেশি বসবাস করত। প্রকৃতপক্ষে আমরা এদেরই উত্তরাধিকার। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমনই ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে নগর সভ্যতা গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সভ্যতা আমাদের নগরায়ণের দিকে ধাবিত করে।
তথ্য সহায়িকা : ১. আহমদ শরীফ: চট্টগ্রামের ইতিহাস; ২. আবদুল হক চৌধুরী: চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা; ৩. হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা, ৪. হুমায়ুন আজাদ : লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী; ৫. চৌধূরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি: চট্টগ্রামের ইতিহাস; ৬. আলী ইমাম: আলোর পাখি, ৭. ড. উদিতি দাশ : চট্টগ্রামের জনপদ : এক নীরব গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যজন