একুশে ফেব্রুয়ারি আসলেই মনে হয় বছরে একবার শহীদ মিনার রং করে ফুল দিয়ে ছবি তুলে মানুষকে দেখানোর জন্য এই দিনটি পালন করা হয়, আমরা যদি সত্যিকার অর্থে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাশীল হতাম তাহলে মনে হয় সারাবছর গায়ে হলুদ কিংবা পূজোতে ডিজে, হিন্দি গান বাজাতাম না, সকাল বিকাল রাতে ভার্চ্যুয়ালে ইংরেজিতে গুডনাইট গুডমর্নিং বলতাম না। শুধুমাত্র বিশেষ দিনে বাঙালিয়ানা পোশাক পরে নিজেকে বাঙালি দেখাতাম না।
বেশীরভাগ ধনী বাঙালিরা খুব শ্রদ্ধা ভরে শহীদ মিনারে একদিন ফুল দেয় কিন্তু সন্তানদের পড়ালেখা করায় শহরের নামীদামি ইংলিশ মিডিয়াম বিদ্যালয়ে। ঘরে সবসময় ছেলেমেয়েদের সাথে ইংরেজি ভাষার চর্চা চলে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় সিনেমা দেখার চেয়ে তারা বিদেশি মুভি দেখতে পছন্দ করে।
এই একটা দিন এলেই আমরা সাদাকালো পোশাক পরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে ভাষাপ্রেমী প্রমাণ করি কিন্তু বেশীরভাগ বাংলা লেখা হয় ইংরেজি হরফে, অনেকেই আবার কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে নিজেকে মেকী স্মার্ট প্রমাণ করে।
“আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” এই দিবসটি শুধুমাত্র মাহাত্ম্য শুধুমাত্র বাঙালি জাতির হৃদয় ভাসবে। ভাষার জন্য বাঙালির এমন বলিদান পৃথিবীর আর কোন সংগ্রামী ইতিহাসে নেই, কিন্তু আমরা কি তাঁর সত্যিকারের তাৎপর্য কিংবা মর্যাদা কয়জনে উপলব্ধি করি, যেহেতু ইংরেজি আমাদের আন্তর্জাতিক ভাষা, এই ভাষা শুধুমাত্র কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার হোক।বিয়ের কার্ড থেকে শুরু করে প্রতিটা দোকানের সাইনবোর্ড যেন আমরা বাংলায় লেখার চেষ্টা করি, এমন কি সন্তানের নাম রাখার জন্য বাংলা নামের উপর গুরুত্ব দেবো। সন্তান আধৌ আধৌ কথা বলতে শুরু করলে তাকে আমাদের ছোট ছোট বাংলার ছড়া শেখাবো, হাতে তুলে দেবো আমাদের গৌরবময় বর্ণমালার আদর্শলিপি, তা না করে আমরা বেশিরভাগ মা-বাবারা ছোটবেলায় সন্তানদের সামনে টিভি খুলে দিয়ে টিনটিন কিংবা টম এন্ড জেরি কাটুন মগজে ঢুকিয়ে দিই, আমাদের সন্তানরা জানে না ক্ষীরের পুতুল কিংবা টুনটুনির গল্পের মত আরো অনেক শিশু কিশোর সাহিত্য আমাদের সম্পদ। বর্তমান যুগে আমাদের স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিকরা শিশু-কিশোরদের জন্য অসাধারণ সব ছোট গল্প ছড়া লেখেন কিন্তু আমরা কয়জনে সেই সব বই সন্তানদের হাতে তুলে দেই। নিজের মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসাটা আসলে বলে কয়ে হয় না, এটা বাঙালির একমাত্র নিজস্ব আবেগের ব্যাপার, পরিবার থেকেই একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করে হবে, আমরা যেভাবে ভাষাকে শ্রদ্ধা ভালবাসা দেখাবো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তাই শিখবে। শুধুমাত্র ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিলেই ভাষাসৈনিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি দেখানো হয় না, আমাদের দৈনন্দিন কাজে, আমাদের চেতনায় শহীদদের আত্মত্যাগের কতোটা মূল্যায়ন করছি কিংবা মাতৃভাষার প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধাশীল! এখন সেই প্রশ্ন করার সময় এসেছে।